ক্ষমতাসীনদের সাথে সমঝোতা ছাড়া কি ব্যবসা সম্ভব?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য, টেন্ডার এবং চাঁদাবাজিসহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে গ্রেফতাকৃতদের পাহাড় সমান সম্পদ বা অর্থের নানান গল্প এখন প্রকাশিত হচ্ছে।
এখনও পর্যন্ত এই গ্রেফতারকৃতদের বেশিরভাগই যুবলীগ এবং ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত।
আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে তাদের দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে সপ্তাহখানেক আগে।
কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া কি কোন ব্যবসা করা সম্ভব?
উত্তরাঞ্চলীয় রাজশাহী বিভাগে একজন নারী উদ্যোক্তা বলছেন, ছোট একটি দোকান নিয়ে প্রায় দুই যুগ আগে যখন তিনি বুটিকের ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তখনও সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের চাঁদা দিতে হয়েছিল।
এখন তাঁর কারখানায় ৮শ জনের মতো নারী শ্রমিক কাজ করেন।
তিনি বলছেন, বিভিন্ন সময়ে তাকে চাঁদা দিতে হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই চাঁদার অংক বেড়ে গেছে। তিনি বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের সাথে জড়িত স্থানীয়র ব্যক্তিরা তার কাছ থেকে নিয়মিতএই চাঁদা আদায় করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নারী উদ্যোক্তা বলছিলেন, কখনও কখনও রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনে, কখনও বা সমঝোতার মাধ্যমে তিনি নিজের ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন।
“বুটিকের ব্যবসায় আমি প্রতি বছর মেলার আয়োজন করি। সেই মেলা করার জন্য মাঠ পাওয়া বা অনুমতির জন্য হয়রানির শিকার হই। টাকা দিয়েই আমি মাঠ নিচ্ছি। কিন্তু রাজনৈতিক ছেলেরা এসে বাধা দেয় যে, আমাকে মাঠ দেয়া যাবে না। তখন আমি সমঝোতা করি। এভাবেই এপর্যন্ত এগিয়ে এসেছি।”
বিভিন্ন এলাকায় ছোট, বড় এবং মাঝারি- বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলেও একই ধরণের চিত্র পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের সব সংগঠনও সব সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় এলেই তারা ব্যবসা বাণিজ্যসহ সব কিছুর মালিক হতে চায়। আওয়ামী লীগ লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকায় সেই প্রবণতা বেড়ে গেছে।
সরকারি কেনাকাটা বা অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারি ব্যবসা পুরোপুরি ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এর বাইরে ব্যক্তি মালিকানার ব্যবসাতেও রাজনৈতিক প্রভাব চরম পর্যায়ে চলে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
তারা বলছেন, ব্যবসা কেউ করতে চাইলে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে হবে এবং সেটা না থাকলে তাকে ক্ষমতাসীনদের প্রভাবের সাথে সমঝোতা করে এগুতে হবে। গ্রামের হাটে ব্যবসা থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই এটা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, রাজনীতি এবং ব্যবসা একাকার হয়ে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
“সরকারি কেনাকাটা ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের এই চিত্র যখন মাঠ বা স্থানীয় পর্যায়ে যায়, তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অন্য কিছু না হলেও এটা ভাবতে থাকেন যে আমাকে চাঁদা না দিলে বা সুবিধা না দিলে আমি ব্যবসা করতে দেবো না। এখন এই পরিস্থিতি একেবারে চড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে,” বলেন তিনি।
ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র প্রভাবের কারণে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং অবৈধ কাসিনো বাণিজ্যের মতো নানা ধরনের অবৈধ কর্মকান্ড চলছে।
আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের অনেকে মনে করেন, দিন শেষে সেগুলোর দায় সরকারের ওপর গিয়েই পড়ছে।
তবে ই-টেন্ডার পদ্ধতি চালু করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপও নিতে দেখা গেছে। তাতেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী ড: আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, ই-টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করা এবং তদারকি বাড়ানোর কারণে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।
“দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন কর্মকান্ডে সরকারের যেখানে সম্পৃক্ততা, সেখানে বাজেটের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই থাকে উন্নয়ন বাজেট। এর শতকরা ৮০ ভাগই থাকে কেনাকাটা সংক্রান্ত। এরমধ্যেই টেন্ডারে দুর্নীতিটা হয়। এই কেনাকাটার ক্ষেত্রে আগে তদারকি বা স্বচ্ছ্বতা ছিল না। এখন ই-টেন্ডারের মাধ্যমে সব হচ্ছে।”
একইসাথে তিনি বলেছেন, “এই ই-টেন্ডার পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতে থাকছে। এতে কিন্তু একটা তারিখও পরিবর্তন করা যায় না। সম্প্রতি যেসব ঘটনা আমরা জানছি, এগুলোও ঘটছে। তবে সময়ের সাথে সাথে এটাও কমে আসবে।”
ড: রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন, ব্যবসা বাণিজ্যে রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে আনতে সরকার এখন টেকসই পদ্ধতি দাঁড় করানোর বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে যেন প্রশ্ন না থাকে সেজন্য সরকারকেই সারাদেশে তাদের নেতাকর্মীদের কাছে সেই বার্তা আগে পৌঁছে দিতে হবে।
তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা বলছেন, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার পর এখন চলমান অভিযানের মাধ্যমে তাদের সবপর্যায়ের নেতাকর্মীদের একটা সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
সূত্র: বিবিসি