কিশোর গ্যাং দমনে তৎপর গাজীপুর প্রশাসন
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রাজধানীর পাশ্ববর্তী জেলা গাজীপুরে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ঘটেছে খুনের ঘটনা। আধিপত্য বিস্তার করতে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছাত্র বা একই এলাকায় বসবাসের সূত্রে উঠতি বয়সের কিশোররা এ সব গ্যাং তৈরি করছে। এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন অভিভাবকরা।
তবে উঠতি এসব কিশোর গ্যাং দমনে র্যাব-পুলিশ খুবই তৎপর রয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে গাজীপুর জেলা শহর ও টঙ্গীতে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অপর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য খুনের সাথে জড়িত বেশ কয়েজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিয়েছে।
টঙ্গীর বিসিক ফকির মার্কেট পাগার মদিনাপাড়া এলাকায় বাড়ি শুভ আহমেদের (১৬)। সে ফিউচার ম্যাপ স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। গত ৭ জুলাই রাতে শুভ তার মায়ের কাছ থেকে চুল কাটানোর জন্য টাকা নিয়ে বাইরে যায়। পরদিন সকালে মদিনাপাড়ার একটি পাকা রাস্তার পাশে ঝোঁপের মধ্যে তার লাশ পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় জড়িত স্থানীয় নবগঠিত একটি গ্যাংয়ের সদস্য মৃদুল হাসান পাপ্পু ওরফে পাপ্পু খাঁন (১৭), সাব্বির আহমেদ (১৬), রাব্বু হোসেন রিয়াদ (১৬), নূর মোহাম্মদ রনি (১৬) নামে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সে সময় হত্যার কাজে ব্যবহৃত ১টি ধারালো সুইস গিয়ার চাকুও উদ্ধার করা হয়।
এ হত্যাকান্ডের মামলার প্রধান আসামী মৃদুল হাসান পাপ্পু র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, সেও ফিউচার ম্যাপ স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের এলাকার নবগঠিত একটি গ্যাং গ্রুপের সদস্য সে। ছয় মাস আগে শুভ একই স্কুলের নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলে তার সাথে পরিচয় হয়।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আগের দিন তারা শিক্ষা সফরে গিয়েছিল। শিক্ষা সফর থেকে ফেরার পথে পাপ্পু ও তার বান্ধবী একই সিটে বসলে শুভ মুঠোফোনে তাদের ছবি তোলে এবং অন্য সবাইকে দেখিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আকষ্মিক ছবি তোলাতে পাপ্পু ক্ষুদ্ধ হয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া ও হাতাহাতি হয়।
এরই জের ধরে পাপ্পু, সাব্বির, রাব্বু ও রনি তাদের গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে ঠাট্টা-অপমানের প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কৌশলে শুভকে নির্জন স্থানে ডেকে নেয় তারা। এরপর মারধর শুরু করে। এক পর্যায়ে সাব্বির ও রাব্বু সুইস গিয়ার চাকু দিয়ে শুভর বুকে ও পিঠে আঘাত করে। পরে রনি সাব্বিরের কাছ থেকে চাকু নিয়ে শুভর মাথায় আঘাত করে। শুভ দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে পাপ্পু তাকে পিছন থেকে ধাওয়া করে। পিঠে আঘাত করলে মাটিতে পড়ে যায় শুভ। সেখানেই তার মৃত্য হয়।
জিএমপির টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি কামাল হোসেন জানান, এ ঘটনায় চার কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রোধে থানা এলাকার টহল এবং নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে সামান্য ‘তুই’ বলাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বের জেরে নুরুল ইসলাম ওরফে নুরু (১৬) নামে এক কিশোর খুন হয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে খুন হয় ছেলেটি। সে ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের সদস্য ছিল।
হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্যাংয়ের মূল হোতাসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে ব্যাব-১। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দু’টি চাপাতি ও একটি ছোরাও উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব এসব তথ্য জানায়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থানার সুরাটি এলাকার বাদল মিয়ার ছেলে ও ‘ভাই-ব্রাদারস’ কিশোর গ্যাংয়ের লিডার রাসেল মিয়া (১৮), গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নতুনপটকা এলাকার মনু মিয়ার ছেলে সৌরভ (২১), কালীগঞ্জ উপজেলার বনগ্রাম এলাকার মহসিন শিকদারের ছেলে জোবায়ের (১৭), সিরাজগঞ্জের শাহাজাতপুর থানার জুগনিদাই এলাকার শামীম হোসেনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম (১৭), জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানার ডালবাড়ী এলাকার খায়রুল শেখের ছেলে আমির হামজা (১৯) এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জামতলা এলাকার আব্দুল ওয়াদুদ পাটোয়ারীর ছেলে সুজন পাটোয়ারি (১৭)।
র্যাব জানায়, বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাত সাড়ে ১০টা থেকে বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) ভোর রাত সোয়া ৩টা পর্যন্ত র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল অভিযান চালায়। আসামিদের ধরতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্নস্থানে অভিযানটি পরিচালিত হয়। অভিযানে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের লিডার রাসেল মিয়াসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দু’টি চাপাতি ও একটি ছোরা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া তাদের কাছে থাকা পাঁচটি মোবাইল ফোন ও নগদ ৮ হাজার ২০ টাকা জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানায় র্যাব।
র্যাব আরো জানায়, গত ৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাজদীঘির পাড় এলাকায় ‘ভাই-ব্রাদারস’ ও ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরেই দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্ব। সংঘর্ষে ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের সদস্য নুরুল ইসলাম ওরফে নুরু (১৬) নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে ‘ভাই-ব্রাদারস’এর সদস্যরা।
এ ঘটনায় নিহতের পিতা মো. ফকির আলমগীর বাদী হয়ে গাজীপুর সদর থানায় মামলা করেন। নিহতের পিতা ফকির আলী পাখি বিক্রেতা ও মাতা গৃহিনী। নুরুল ইসলাম ফেরি করে চা বিক্রি করত।
র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঘটনার দু’দিন আগে নুরুল ইসলামের ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের ৬/৭ জন সদস্য স্থানীয় বালুরমাঠ এলাকায় আড্ডা দিচ্ছিল। সে সময় ‘তুই’ বলা’কে কেন্দ্র করে ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের রাসেলের সাথে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। জুনিয়র গ্রুপের কাছে লাঞ্চিত হওয়ায় রাসেলের ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের সদস্যরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
তারই জের ধরে গত ৩ সেপ্টেম্বর ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের ১০/১২ জন মিলে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ‘দীঘিরপাড়’ গ্রুপের উপর অকস্মাৎ চড়াও হয়। সে সময় ভিকটিম নুরুল তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যরা পালিয়ে যায়। ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের সদস্যরা নুরুলকে পুকুর থেকে তুলে ধারালো চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। এতে মারা যায় নুরুল। পরে লাশ রেখে পালিয়ে যায় ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের সদস্যরা।
র্যাব আরো জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আসামিরা জানিয়েছে, তাদের গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যই স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন আছে যারা পড়ালেখা করে না। একই এলাকায় বসবাসের সূত্রে এসব কিশোর গ্যাং গঠিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র স্কুল পর্যায়ে ছোট দল করে ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও, সময়ের সাথে তারা এলাকা ভিত্তিক গ্যাংয়ে পরিণত হয়।
এরপর তারা ওই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টা করে। পাশাপাশি চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন বেআইনি কাজের সাথে জড়িত হয়। আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য তারা স্থানীয়ভাবে বিশেষ প্রভাব আছে এমন কিশোরদেরও দলে নেয়। তাদের অধিকাংশই পড়াশোনার মাঝ পথে ঝরে পড়েছে।
একই এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং থাকায় একে অপরকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ফলে ছোট খাট বিষয় নিয়ে অধিকাংশ সময় নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে গ্যাং গুলো। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবং বিপক্ষ গ্রুপকে ভীত সন্ত্রস্ত করতেই এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে বলে স্বীকার করেছে ‘ভাই-ব্রাদারস’ এর সদস্যরা।
এদিকে জেলার শহরকেন্দ্রীক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির সাথে জাড়িয়ে পড়ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন পাড়া মহল্লার বিড়ি-সিগারেট, চায়ের দোকান, হোটেল এসব স্থানে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র বা উঠতি বয়সের কিশোরদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। স্কুল বা কলেজ চালাকালীন অথবা আগে পরে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় স্কুলের আশপাশে, অলি-গলিতে তাদেরকে দল বেধে আড্ডা দিতে দেখা যায়। সরেজমিনে জেলা শহরের রাজবাড়ী মাঠ, রাজদীঘির পাড়, শ্মশান, মাধববাড়ি, হাড়িনালসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
হাড়িনাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আক্তার হোসেন জানান, ছাত্ররা যেন কোনো গ্যাং বা অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে। তারা যেন পড়াশোনায় মনোযোগী হয়, সেজন্য তাদেরকে ক্লাসে বোঝানো হচ্ছে। স্কুলে আসার নাম করে তারা আড্ডা দিচ্ছে কি না এর জন্য প্রতিনিয়ত স্কুলের আশপাশে খোঁজ এবং নজরদারি করা হয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) প্রথম বর্ষপূর্তিতে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় অনুষ্ঠান হয়। সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জিএমপি কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘স্কুল-কলেজ চলাকালীন, শুরুতে বা শেষে এসব জায়গা গুলোর প্রতি আমরা বিশেষভাবে নজর দেব। সমাজ ও দেশের ভবিষ্যৎ এসব কিশোর-তরুণরা বিপথে গেলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।’
র্যাব-১ এর পোড়াবাড়ি ক্যাম্প কমান্ডার লে. কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘গাজীপুরে কিশোর গ্যাং বেড়ে গেছে। সেজন্য গোয়েন্দা নজর দারিও বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মার্কেট বা পাড়ায় মানুষকে বিরক্ত করলে বা নিজেরা সংগঠিত হয়ে আপরাধ ঘটানোর চেষ্টা করলে তাদের রিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সম্প্রতি তিনটি ঘটনায় দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপ আরেকটি গ্রুপকে আক্রমণ করে। এতে তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। আমরা তাদের সাবইকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজের শিক্ষক, পাড়ার মুরব্বিসহ সামাজের লোকজন যদি বোঝায় যে, কিশোর গ্যাং কালচার থেকে তোমরা বেরিয়ে আস। এই কালচারের ফলে তোমরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছ, অন্যদেরও ক্ষতি করছ। গণমাধ্যম যদি প্রচার করে, কিশোর গ্যাং করে কেউ রক্ষা পাবে না। সবাই আইনের আওতায় চলে আসবে। তোমাদের বিরুদ্ধে র্যাব-পুলিশ যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এতে আশা করি কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা কমে আসবে।’