কাশিমপুর কারাগারে বন্দি থেকেও ফেসবুক ও মেসেঞ্জার অ্যাকটিভ সুমন, দিচ্ছে হত্যার হুমকি!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কাশিমপুর কারাগারে বন্দি রাজধানীর পল্লবীর আলোচিত সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার তিন নম্বর আসামি ও মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন আসামী মো. সুমন (৩৫) মোবাইল ফোনে চালাচ্ছে গ্যাং। ফোনে দিচ্ছেন হুমকি। প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে অ্যাকটিভ থাকতে দেখা যায় সুমনকে।
এ ঘটনায় আতঙ্কে দিন পার করছে নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী। নিহতের পরিবার বলছে, সাহিনুদ্দিনকে হত্যার পরে কাশিমপুর কারাগারে বসে মাঈনুদ্দীনকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে আসামি সুমন।
চলতি বছরের ১৬ মে ৮ বছরের শিশু মাশরাফির সামনে বাবা সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করে সুমন ও তার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার হয় ১৩ আসামি। এছাড়া গ্রেফতার অভিযানে হত্যাকাণ্ডের সরাসরি জড়িত থাকা দুই আসামি মনির ও মানিক ও র্যাব ও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি সুমন কারাগারে বসে চালাচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের অপরাধকাণ্ড। ফোন করে হুমকি দিচ্ছেন ভুক্তভোগীর পরিবার ও এলাকাবাসীদের।
১৯ মে গ্রেফতারের পর থেকে কারাগারে থাকলেও ১৭ আগস্ট স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুলকে ফোন করে হুমকি দেন সুমন। আসামিকে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে অ্যাকটিভ থাকতে দেখা যায়।
আসামির মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে পল্লবী থানা ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ সহসভাপতি শিহাব সর্দার নাজমুল বলেন, হত্যাকাণ্ড ঘটার পরে আসামিদের আমি ফাঁসি দাবি করি। আমি কেন সুমনের ফাঁসি চাইলাম, সেজন্য সে (সুমন) আমাকে ফোন করে বলে, ‘তুই কেন আমার ফাঁসি চাইবি। তুই থাকিস। আমি রশি নিয়ে আইতাছি। তখন তুই আমারে ফাঁসিতে ঝুলা আইছ। ’
শিহাব সর্দার নাজমুল আরও বলেন, মাফিয়াদের মতো ফোন করে হুমকি দিচ্ছেন সুমন। আমি এখন টেনশনে থাকি। আগে যেমন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারতাম, তা এখন আর পারছি না। মনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
নিহত সাহিনুদ্দিনের মা মোছা. আকলিমা খাতুন বলেন, জেল থেকে সুমন ফোন করে হুমকি দিচ্ছেন। বলছে, ‘মাঈনুদ্দিনকে রেডি থাকতে’।
এ বিষয়ে কাশিমপুর কারাগার সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল বলেন, আসামি সুমন মোবাইল ব্যবহার করছে, বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে আমরা ব্যবস্থা নেব।
কে এই সুমন?
সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার বস্তি থেকে মিরপুর ১২ নম্বর, ট-ব্লক, এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে সুমন পাটোয়ারী। তিনি তখন এনা পরিবহনের কন্ডাকটর ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এনা পরিবহনের সুপারভাইজার হর।
এনা পরিবহনের চাকরি ছেড়ে তিনি ২০১৪ সালে তরকারির পিকআপ ভ্যান চালানো শুরু করেন। এর কিছুদিন পর রব রব পরিবহনের ড্রাইভারি কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালে তিনি মিরপুর ১২ নম্বর সি-ব্লকে একটি হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসায় তিনি সুবিধা করতে পারেননি। পরে ছেড়ে দেন হোটেল ব্যবসা।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৬ সালে সুমন যোগ দেন শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে। শ্রমিক লীগ নেতা বাদলের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে শ্রমিক লীগ ছেড়ে যোগ দেন ছাত্রলীগে। দুই নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীরের সঙ্গে গড়ে তোলেন সখ্যতা।
সুমনের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কোনো পদ-পদবি না থাকলেও পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। ফেসবুক আইডিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর সাবেক সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে রেখেছেন সুমন।
২০১৭-২০১৮ সালে সুমনের সঙ্গে পরিচয় হয় মাদক ব্যবসায়ী ইব্রাহিমের। তার সঙ্গে প্রথমে গাঁজার ব্যবসা শুরু করলেও সুমন ধীরে ধীরে যুক্ত হন ইয়াবার ব্যবসায়। সুমন মাদক ব্যবসা বড় করতে ধীরে ধীরে তৈরি করেন গ্রুপ বা বাহিনী। তার গ্রুপে যুক্ত হতে থাকেন পল্লবী থানা এলাকার বখে যাওয়া কিশোর ও যুবক। ছিনতাইকারী ও মাদক কারবারীদের নিয়ে তৈরি করেন সুমনের নিজস্ব বাহিনীর বা গ্রুপ। সুমন বাহিনী মিরপুর এলাকায় মাদক কারবারি ও ভাড়াটে গুণ্ডা হিসেবে কাজ করে।
চলতি বছরের ১৬ মে পল্লবীতে আধিপত্য বিস্তার ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সন্তানের সামনেই সাহিনুদ্দিন (৩৪) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিন বিকেলে সাত বছর বয়সী শিশু সন্তান মাশরাফিকে নিয়ে মোটরসাইকেলে ঘুরছিলেন সাহিনুদ্দিন। এমন সময় একজনের ফোনকল পেয়ে পল্লবীর ৩১ নম্বর রোডে দেখা করতে যায়।
সেখানে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা শিশু মাশরাফিকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে তার বাবা সাহিনুদ্দিনকে ৬-৭ জন এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন। ৫-৬ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
সাহিনুদ্দিনের মাথা, গলাসহ উপরের অংশ ধারালো অস্ত্রের কোপের অসংখ্য জখম পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় নিহত সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে নামধারী ২০ জনকে এবং অজ্ঞাত পরিচয় ১৪-১৫ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে এর তদন্ত দেওয়া হয় গোয়েন্দা (ডিবি) মিরপুর বিভাগকে।
নিহত সাহিনুদ্দিন রাজধানীর পল্লবীর উত্তর কালশীর সিরামিক এলাকায় বসবাস করতেন। তার পরিবারে মা আকলিমা বেগম, ভাই মাঈনুদ্দিন ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন।
২০২০ সালে সাহিনুদ্দিনের বাবার মৃত্যুর পর থেকেই বাউনিয়া মৌজার উত্তর কালশীর বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকায় তাদের ১০ একর জমি দখলের পাঁয়তারা করছিলেন সাবেক এমপি আউয়াল। সাহিনুদ্দিনদের ওই জমির পাশেই বেশ কিছু জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে ‘হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড’ নামের আবাসন প্রকল্প গড়েছেন আউয়াল। সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
সূত্র: বাংলানিউজ