আইন-আদালতআলোচিত

প্রবাসীর ‘সর্বস্ব’ লুটের নেপথ্যে সিআইডি কর্মকর্তা, ঘুষের অভিযোগ ডিবির বিরুদ্ধে

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দুবাই প্রবাসী এক ব্যক্তিকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আটকিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়েছিলেন সিআইডির এক কর্মকর্তা। তার সঙ্গে ছিল সিআইডির আরেকজন রাইটার, আর বেশ কয়েকজন পেশাদার ডাকাত ও ছিনতাইকারী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গ্রেপ্তারের নামে তাকে রাজধানীর কাউলা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। পরে হাত-পা ও চোখ বেঁধে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয় ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায়। পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ডাকাতি করা এই চক্রটিকে ঘটনার তিন মাস পর শনাক্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

সে সময় গ্রেপ্তার করা হয় ডাকাত দলের ছয় সদস্যকেও। তবে এতদিন বিষয়টি ছিল গোপন। এক বছর আগের এই ঘটনা সম্প্রতি আলোচানায় এসেছে একটি অডিও ক্লিপের সূত্র ধরে। ওই অডিও ক্লিপে অভিযুক্ত সিআইডি কর্মকর্তার স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, আসামীদের ছাড়িয়ে নিতে তারা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা নিয়েও ডিবি পুলিশ কাউকে ছাড় দেয়নি। উল্টো বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে সিআইডির ওই কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ আগস্ট মাদারীপুরের বাসিন্দা রোমান নামে এক ব্যক্তি ভোরে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। রাজধানীর টিকাটুলী থেকে সিএনজিযোগে বিমাবন্দর যাওয়ার পথে তাকে অনুসরণ করে একটি হাইএস গাড়ি ও তিনটি মোটর সাইকেল। তারা বিমানবন্দরের আগে কাউলা এলাকায় গিয়ে সিএনজিকে ব্যারিকেড দিয়ে আটকায়। তারপর রোমানকে বেধরক মারধর করে লাগেজসহ গাড়িতে তুলে নেয়। পরে তাকে গাড়িতে তুলে হাতে হাতকড়া পড়ানো হয়। বাঁধা হয় চোখ ও হাত-পা। রোমানের লাগেজে থাকা পাঁচ হাজার ইউএস ডলার ও দুই হাজার দেহরাম ও বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকা নিয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পরদিন ২০ আগস্ট বিমানবন্দর থানায় রোমান নিজেই বাদী হয়ে একটি দস্যুতার মামলা দায়ের করেন।

সূত্র জানায়, মামলাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বিমানবন্দর জোনাল টিম। সড়কে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে এই চক্রটির সঙ্গে সিআইডির একজন উপ-পরিদর্শক জড়িত। আকসাদুর জামান নামে ওই উপ-পরিদর্শক সিআইডির অফিসিয়াল গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ১৯-২২৩৭) নিয়ে ডাকাতিতে নেতৃত্ব দেন। পরে একে-একে গ্রেপ্তার করা হয় সিন্ডিকেটের ছয় সদস্য- সিআইডির রাইটার (সিভিল সদস্য) মোশারফ হোসেন, সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন তালুকদার, রিজু মিয়া ও হাসান রাজাকে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত সৈনিক হাসান রাজা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ওই জবানবন্দীতে সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানের নেতৃত্বে ডাকাতি করার পুরো বিষয় তুলে ধরে। এছাড়া সিআইডির অফিসিয়াল ওই মাইক্রোবাসের চালক হারুনুর রশীদ সজীবও আদালতে সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। সেও এসআই আকসাদুদের নেতৃত্বে প্রবাসীর স্বর্বস্ব লুটে নেওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

আকসাদকে ছাড় দেয় ডিবি পুলিশ

সূত্র জানায়, পেশাদার ডাকাত দলের সদস্যদের নিয়ে অপরাধী চক্র গড়ে তুলে মাঝে মধ্যেই প্রবাসীদের টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নিত সিআইডির পুলিশ কর্মকর্তা এসআই আকসাদুদ জামান। সোর্সের মাধ্যমে তিনি প্রবাসী টার্গেট ঠিক করতেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এসআই আকসাদকে তার সোর্স এক ব্যক্তি দশ লাখ টাকা নিয়ে বিদেশ যাওয়ার তথ্য জানান। প্রতি উত্তরে এসআই আকসাদ দশ লাখ রিয়াল নাকি ডলার তা জানতে চান। সোর্স টাকা বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে এত ছোট টাকার কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পুরো বিষয়টি জানার পরও আকসাদুদ জামানকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখায়নি। তবে বিষয়টি জানিয়ে সিআইডিতে একটি চিঠি পাঠিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের ইমেজ রক্ষার জন্যই তাকে মামলার আসামী করা হয়নি। তবে তার যেন শাস্তি হয় এ কারণে পুরো বিষয়টি সিআইডিকে জানিয়ে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করেছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা।

দেড় কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ডিবির বিরুদ্ধে

আলোচিত এই ঘটনাটি প্রায় এক বছর ধরে গোপন থাকলেও সম্প্রতি একটি অডিও ক্লিপের সূত্র ধরে তা আলোচানায় আসে। ওই অডিও ক্লিপে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন এসআই আকসাদুদ জামানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের। আর অভিযুক্ত কর্মকর্তা হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়শী। অডিওতে তাহমিনা আক্তার ডিবি কর্মকর্তা কোরায়শীকে এক কোটি ২৮ লাখ টাকার পাশাপাশি তাকে আরও ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়শীকে পুরো টাকা স্যারদের কাছে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে এখান থেকে কিছু ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থার কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি বারবার সাক্ষাতে কথা ও অফিসে দেখা করতে বলেন।

যোগাযোগ করা হলে এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়সী ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, অডিওটি টেম্বারড ও ফেব্রিকেটেড করে তৈরি করা হয়েছে। ডাকাতির ঘটনায় এসআই আকসাদুদের চাকরি চলে যাওয়ায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে এই কাজ করেছে। এর আগেও আকসাদুদ তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে বলে জানান গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা।

কিসের টাকা, কি জন্য দেওয়া হয়েছিল?

আলোচনায় আসা অডিও ক্লিপে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা কেন ডিবির কর্মকর্তাকে দেওয়ার অভিযোগ করছেন এসআই আকসাদুদ জামানের স্ত্রী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, প্রবাসীর সর্বস্ব লুটের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের ছাড় দেওয়ার জন্য এই টাকা জোগাড় করা হয়েছিল। সিআইডির উপ-পরিদর্শক আকসাদুদ জামানের ঘনিষ্ঠ একজন জানান, মামলা থেকে ছাড় পেতে আসামীরা সবাই এই টাকা দিয়েছিল। এর মধ্যে মোশারফ ৩৩ লাখ, সেলিমও প্রায় সমপরিমাণ, আমির হোসেন ১৩-১৪ লাখ, রিজু মিয়া ৬-৭ লাখ মাওলা ৫ লাখ, রিপন ৩-৪ লাখ টাকা দেন। গত বছরের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর খিলগাঁও এলাকা আকসাদুদ জামানের বাসায় এই টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিভাগীয় মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি এসআই আকসাদুদ জামানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একারণে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছেন। পুরো বিষয়টি তিনি ডিএমপি কমিশনার, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button