আলোচিতসারাদেশ

মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই চলছে রেলওয়ে!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সময়মতো বহরে নতুন ইঞ্জিন যোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায়, বাংলাদেশ রেলওয়েকে মেয়াদোত্তীর্ণ লোকোমেটিভের (ইঞ্জিন) ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হচ্ছে। বর্তমানে এসব জরাজীর্ণ ইঞ্জিন নিয়েই কোনোমতে চলছে রেলের কার্যক্রম।

বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা বলছেন, দুর্বল পরিকল্পনা, দীর্ঘ ক্রয় প্রক্রিয়া, ঠিকাদারদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চালান সরবরাহে ব্যর্থতা এবং কোভিড-১৯ মহামারির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৭ শতাংশ লোকোমেটিভই মেয়াদোত্তীর্ণ।

ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থাটি সেবা মানের প্রত্যাশা পূরণ করতে এবং নির্ধারিত সময়ে ট্রেন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। একইসঙ্গে, এর পরিচালন ব্যয়ও বাড়ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে ২৬৩টি লোকোমোটিভ রয়েছে। সবশেষ ডেটা অনুযায়ী, এগুলোর মধ্যে ১৭৫টিই মেয়াদোত্তীর্ণ, যা মোট লোকোমোটিভের ৬৭ শতাংশ। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব লোকোমোটিভের মধ্যে ৭৮টি ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। এমনকি ১৯৫৩ সালে কেনা নয়টি লোকোমোটিভও বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ একটি লোকোমোটিভের সেবার আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর।

মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন নিয়ে কার্যক্রম চালাতে গিয়ে রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরেই হিমশিম খাচ্ছিল। গত এক দশকে ১০০টিরও বেশি নতুন ট্রেন বহরে যুক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

এ সংকট এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, রেলওয়েকে ভারতীয় রেলওয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে ভারতের কাছ থেকে ১০টি ব্রডগেজ (বিজি) লোকোমোটিভ উপহার পায় বাংলাদেশ রেলওয়ে।

তবে, বাংলাদেশ রেলওয়ের পাইপলাইনে থাকা ১৪০টি লোকোমোটিভ আগামী তিন বছরের মধ্যে বহরে যোগ দিলে সংকট কিছুটা হলেও লাঘব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি ইঞ্জিন ইতোমধ্যেই দেশে পৌঁছেছে এবং ১০টি আগামী মাসে কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার মেয়াদোত্তীর্ণ লোকোমোটিভ সংক্রান্ত সমস্যার কথা স্বীকার করেন।

তিনি জানান, ব্যবহারযোগ্য রাখার জন্য তারা লোকোমোটিভগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। এ ছাড়া, সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অধীনে নতুন লোকোমোটিভ সংগ্রহ করছেন তারা।

বর্তমান অবস্থা

রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গত সোমবার রেল ভবনে লোকোমোটিভ রক্ষণাবেক্ষণ, প্রাপ্যতা, প্রাসঙ্গিক সমস্যা ও এসবের সমাধান বিষয়ক এক সভায় সভাপতিত্ব করেন।

সভায় রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগ লোকোমোটিভ সংক্রান্ত কিছু সাম্প্রতিক তথ্য প্রকাশ করে বলে সভা সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের নথি অনুসারে, ২৬৩টি লোকোমোটিভের মধ্যে ১৭১টি এমজি (মিটার-গেজ) লোকোমোটিভ ও ৯২টি বিজি (ব্রড-গেজ) লোকোমোটিভ।

১৭১টি এমজি লোকোমোটিভের মধ্যে ১৩২টিই মেয়াদোত্তীর্ণ, যা মোট এমজি লোকোমোটিভের ৭৭ শতাংশ। এ ১৩২টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৬১টি ৫০ বছরের বেশি, ১১টি ৪০ বছরের বেশি, ৩৪টি ৩০ বছরের বেশি এবং ২৬টি ২০ বছরের বেশি পুরনো। শুধুমাত্র ৩৯টি ইঞ্জিনের বয়স ২০ বছরের কম।

বিজি লোকোমোটিভেরও একই অবস্থা। ৯২টি বিজি লোকোমোটিভের মধ্যে ৪৩টিই মেয়াদোত্তীর্ণ, যা মোট বিজি লোকোমোটিভের ৪৭ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে ১৭টি ৫০ বছরের বেশি, ১৪টি ৪০ বছরের বেশি এবং ১২টি ৩০ বছরের বেশি পুরনো। নথি অনুসারে, শুধুমাত্র ৪৯টি ইঞ্জিনের বয়স ২০ বছরের কম।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ রেলওয়ের দুই জ্যেষ্ঠ যন্ত্র প্রকৌশলী লোকোমোটিভ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

নাম গোপন রাখার শর্তে এক প্রকৌশলী জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অনেক বেশি। এ মডেলগুলো ইতোমধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ায় এগুলোর অনেক যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। ফলে তাদেরকে স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হয়। এগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই মানসম্মত হয় না। ফলে ঘন ঘন ইঞ্জিন নষ্ট হয়।

এ ধরনের লোকোমোটিভ দিয়ে নির্ধারিত সময়সূচিতে ট্রেন পরিচালনা করা কঠিন বলে উল্লেখ করেন আরেকজন প্রকৌশলী।

পাইপলাইনে সমস্যা

বাংলাদেশ রেলওয়ের নথি অনুসারে, চলমান প্রকল্পগুলোর অধীনে সংস্থাটি ১৪০টি লোকোমোটিভ কিনবে। এরমধ্যে ১০০টি এমজি ও ৪০টি বিজি। এ ছাড়া, আরও ৪৬টি বিজি লোকোমোটিভ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

২০১৯ সালের মার্চে বাংলাদেশ রেলওয়ে হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে ৬৭৪ দশমিক নয় কোটি টাকায় ২০টি নতুন এমজি লোকোমোটিভ কেনার চুক্তি করে। চুক্তি মতে, এগুলো ২২ থেকে ২৮ মাসের মধ্যে সরবরাহ করার কথা ছিল। ২০২০ সালের জুনে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, চলতি বছর ১০টি লোকোমোটিভ দেশে এসেছে।

বাকি ১০টি ইঞ্জিন চালানের অপেক্ষায় রয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর জানিয়েছেন। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে মার্কিন-ভিত্তিক প্রগ্রেস রেলের সঙ্গে আরও ৪০টি নতুন বিজি লোকোমোটিভ কেনার জন্য চুক্তি করে, যা ২৪ থেকে ৩৬ মাসের মধ্যে সরবরাহ করার কথা।

প্রকল্পটির পরিচালক মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, এরমধ্যে আটটি ইঞ্জিন চলতি বছরের মার্চে দেশে পৌঁছেছে এবং দ্বিতীয় ব্যাচটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে পৌঁছাবে।

প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত থাকলেও, সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় এর মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।

সরকার ২০১১ সালে ৭০টি এমজি লোকোমোটিভ কেনার আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল। এর আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ে হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এক হাজার ৯৮৬ কোটি দশমিক ৫৩ কোটি টাকার চুক্তি সই করে।

১৮ থেকে ৬০ মাসের মধ্যে সব ইঞ্জিন সরবরাহ করার কথা ছিল কোম্পানির। কিন্তু, এর ঋণ চুক্তি এখনো সই না হওয়ায় ২০২৪ সালের জুনের সময়সীমায় কাজ শেষ করা কঠিন। প্রকল্পটির ব্যয় এখন দুই হাজার ৬৫৯ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা।

অন্য আরেকটি প্রকল্পের আওতায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৮ সালের ১৭ মে হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে ২৯৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি এমজি ডিজেল-ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কেনার চুক্তি সই করে।

কোম্পানি গত বছরের সেপ্টেম্বরে লোকোমোটিভগুলো সরবরাহও করে। কিন্তু, এসব লোকোমোটিভের চারটি মূল উপাদান চুক্তিতে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে না বলে নিশ্চিত করে বাংলাদেশ রেলওয়ের দুটি কমিটি।

ফলে ওই লোকোমোটিভগুলো কবে থেকে কাজে লাগানো যাবে, তা বলা সম্ভব নয় বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button