ইতিহাস-ঐতিহ্যগাজীপুরমুক্তমতশিক্ষা

তৎকালীন ‘কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল’ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : শত বছরের পুরোন কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ (আর.আর.এন) পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা লগ্নের কিছু ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ‘অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিকের (স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র) এক লেখা থেকে।

তৎকালীন ‘কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের’ প্রতিষ্ঠা লগ্নের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে লেখকের অনুমতিক্রমে পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো:

“এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই … / মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই/ এই দুনিয়া এখন তো আর/ সেই দুনিয়া নাই, / মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই?/ এই মানুষের ভিরে আমার সেই মানুষ নাই।“

কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায় আমাদের এলাকায় আধুনিক শিক্ষার অগ্রদূত মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর অবিস্মরণীয় অবদান        

মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিক 

ভূমিকা 
এই কথা সর্বজনবিদিত যে ১৮৮৯ সনের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন ঢাকা জিলার অন্তর্গত বৃহত্তর কাপাসিয়া থানাধীন কালীগঞ্জ নামক স্থানে একটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং সর্বসম্মতিকরণে এই এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা মানের নব-প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির নামকরণ করা হয় “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল”। সমগ্র পূর্ব বাংলায় তথা তৎকালীন বৃহত্তর ঢাকা জিলার বিশেষ যুগ সন্দিক্ষনে কালীগঞ্জের মতো একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আধুনিক শিক্ষার আলোকবর্তীকাসম ‘কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ অনেক গৌরবের কথা।

আর একটি শব্দ না লিখেই অতি পরিষ্কার ভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে পাঠকদের বলা প্রয়োজন যে নির্ভরশীল তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী তৎকালীন কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের বিদ্যুৎসাহী মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী মহাশয়ের দৃঢ় নেতৃত্বে কালীগঞ্জের স্থানীয় গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে কালীগঞ্জে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” স্থাপন করেছিলেন। তবে স্কুলের জন্য এক টুকরো উপযুক্ত জমির অভাবে ও অর্থের স্বল্পতার জন্য স্থানীয় মধ্য ইংরেজি স্কুলটিকে উন্নীত করেই “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল।

কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলের মত সফল একটি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়কে বিলুপ্ত করে কালীগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করার মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কালীগঞ্জ-কাপাসিয়া এলাকার এবং এমনকি তৎকালীন কেরানিগঞ্জের উত্তর অঞ্চলের সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীকেই নিতে হয়েছিল।

এই সেই কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ পাইলট হাই স্কুল যদিও ১৮৮৯ সালে যাত্রা শুরু করেছিল অতি ছোট্ট আয়োজনে এবং ছোট পরিসরে তা ধীরে ধীরে মহীরুহের আকার ধারণ করে যুগে যুগে আধুনিক শিক্ষার আলো বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এই সেই কালীগঞ্জ ইংলিশ হাই স্কুল যেখান থেকে সর্ব প্রথম একমাত্র আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিজ্ঞান-মনস্কতা ও বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞানচর্চার “আলোকচ্ছটা” চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের এলাকা থেকে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীভূত করার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিল। এই স্কুলই আমাদের দিয়েছিলো উন্নত জীবনের দ্বারোদ্ঘাটনের চাবিকাঠি।

এই সেই ইংরেজি হাই স্কুল, যেখান থেকে ছাত্ররা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিভিন্ন শহরে অবস্থিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়শোনা করে নিজেদের জন্য হউক আর সমাজের জন্য হউক উন্নত মানের জীবনযাত্রা শুরু করেছে। দেশের ও সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং সন্মানীয় পেশাতে নিয়োজিত আছেন আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষর্থীরা এবং এই স্কুলই গড়ে  তুলেছিল অনেক আলোকিত ও সাদা মনের মানুষ।

এই কথা স্বতঃসিদ্ধ যে ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রাণপ্রিয় স্কুলটির নাম ছিল “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল”। ১৮৯০ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিকভাবে প্রকাশিত ‘একাডেমিক ক্যালেন্ডারে’ অতি পরিষ্কারভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী হাই স্কুলটির নাম “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” হিসেবেই উল্লেখিত রয়েছে। স্মরণ রাখা দরকার যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিকভাবে প্রকাশিত ‘একাডেমিক ক্যালেন্ডারগুলি হলো অকাট্য দলিল। ১৯০২ সালে এই স্কুলের নামকরণ করা হয়েছিল “কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুল”।

কোন সেই দানবীর যাঁর বদন্যতায় কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপিত হয়েছিল? এই স্কুলটি কি ভাওয়াল পরগনার প্রতাপশালী জমিদার রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী নিজ খরচে জয়দেবপুর থেকে নিদেন পক্ষে ১০ মাইল দূরবর্তী ভাওয়ালের একদম দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত কালীগঞ্জ নামক স্থানে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” নামকরণ করে ১৮৮৯ সনে স্থাপন করে দিয়েছিলেন? এই স্কুলটি স্থাপনের ব্যাপারে ভাওয়াল জমিদারের স্ত্রী রানী বিলাসমনি কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন?  যদি কোনো দানবীর বা ধনী জমিদার বা তালুকদার এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা না করে থাকেন তাহলে কে বা কারা এই আলোকবর্তীকাসম কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? কোন সেই বিদ্যুৎশাহী ব্যক্তি যাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে ঢাকা শহর থেকে ২৫ মাইল দূরে কালীগঞ্জের মতো অজপাড়াগাঁয়ে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের” মতো একটি উন্নত প্রবেশিকা মানের হাই স্কুল গড়ে উঠেছিল? কোন সেই মহানুভ ব্যক্তি যিনি মনে করেছিলেন যে কালীগঞ্জেই একটি প্রবেশিকা মানের “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” প্রতিষ্ঠা করা যায়? কোন সেই প্রতিভাবান ব্যক্তি যিনি “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি” প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গেই তড়িৎগতিতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা মানের হাই স্কুল হিসেবে “স্বীকৃতি” আদায় করিয়েছিলেন? আমার এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো এইসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা। তবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায় মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর মুখ্য ভূমিকা ও তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান নিয়ে আলোচনা করাও এই প্রবন্ধটির অন্যতম উদ্দেশ্য।

এই প্রবন্ধের পরিধি ও সীমাবদ্বতা:

আমার এই প্রবন্ধের মুখ্য বিষয় হলো কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও সময় সীমা হলো মোটামোটি ভাবে ১৮৮৬ সাল থেকে ১৮৯৭ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এই সময় সীমার মধ্যে ভাওয়াল জমিদারের যেহেতু কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায় জড়িত থাকার কোন তথ্য নেই সেই জন্য রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়কে স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাঁড় করানোর কোন প্রকার প্রচেষ্টা আমার এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে করা হয় নি।

তবে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ এক যুগ পরে কেন এবং কোন ধরণের আর্থিক পরিস্থিতিতে ১৯০২ সনে আমাদের স্কুলের আদি নাম পরিবর্তন করে “কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুল করা” হয়েছিল তা আমি কোনো একটি আলাদা প্রবন্ধে যথাশীঘ্র ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করব এবং ঐ আলাদা প্রবন্ধে ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত আমাদের স্কুলের আর্থিক দুর্দিনে অবশ্যই রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের অনুদান ও মহানুভবতা নিয়ে আলোচনা করবো। তবে আরো পরিষ্কার করে বলতে চাই যে এই কথা সত্য যে ১৮৮৯ সালে ঐতিহ্যবাহী কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায়  ভাওয়াল রাজার কোন প্রকার সংশ্রব না থাকলেও ১৮৯৭ (১৩০৪ বঙ্গাব্দ) সালের পর স্কুলটির অপ্রত্যাশিত চরম আর্থিক দুর্দিনে রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক অনুদান ছিল চোখে পড়ার মতো। (আমি পুনরায় বলছি এই সম্পর্কে আমি আলাদা প্রবন্ধে আলোচনা করার ইচ্ছা পোষণ করছি)।

কোন জমিদার বা তালুকদার বা জোতদার বা মহাজন ঐতিহ্যবাহী “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” প্রতিষ্ঠা করে দেন নি:

আমি প্রথমেই অতি বিনয়ের সঙ্গে পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন মনে করছি যে কোন জমিদার বা তালুকদার বা জোতদার বা মহাজন আমাদের ঐতিহ্যবাহী “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” প্রতিষ্ঠা করে দেন নি। কোন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ছাড়া মনগড়া এমন কোন দাবি করা হবে মিথ্যাচার।

কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভাওয়াল পরগনার জমিদার রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের অথবা তদীয় স্ত্রী রানী বিলাসমনির ভূমিকা কি ছিল? কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায় দুর্দন্ড প্রতাপশালী— বার্ষিক আয় নয় লক্ষ টাকার ভাওয়াল এস্টেট এর একচ্ছত্র জমিদার রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের অথবা তদীয় পত্নী রানী বিলাসমনির কোনো প্রকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আর্থিক সাহায্যে বা অনুদানে অথবা তাঁর কোনো প্রকার বদান্যতায় বা উৎসাহে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি স্থাপিত হয়নি। কোন প্রকার তথ্য উপাত্ত নেই যার ভিত্তিতে বলা যায় যে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁরা জড়িত ছিল। স্কুলটির “রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ ” নাম দেখেই যারা ধরে নেন যে ভাওয়াল জমিদার এই স্কুলটি স্থাপন করেছিলেন তা সঠিক নয়। মনগড়া ভাবে বা আনুমানিক ভাবে ও কল্পনার ভিত্তিতে বলা সমুচিত নয় যে আমাদের স্কুলটি রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ বা তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠা করেছিল।

তাই আবার পুনুরুক্তি করছি যে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভাওয়াল জমিদার রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের অথবা তাঁর স্ত্রী রানী বিলাসমনির কোনোপ্রকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা ছিলোনা বা উল্লেখ করার মতো কোনো ভূমিকা ছিলোনা। যারা জানেনা তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি যে রায়ত ও প্রজা-হিতৈষী মুন্সেফদেরকে রায়ত-প্রজা বিদ্বেষী জমিদার বা তালুকদার শ্রেণীর লোকেরা সুনজরে দেখতেন না।

কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের বিদ্যুৎসাহী মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী ছিলেন কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ।

পরীক্ষিতও নির্ভরশীল তথ্য-উপাত্ত মোতাবেক তৎকালীন কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের জনদরদী ও বিদ্যুৎসাহী মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী মহাশয়ের উৎসাহ, উদ্দীপনায় ও দৃঢ় নেতৃত্বে কালীগঞ্জের স্থানীয় গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ কালীগঞ্জে এই ইংরেজি মাধ্যমিক বা উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন। কাউকে যদি কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল বা কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুল অথবা আজকের কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ পাইলট সরকারি হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বলে চিহ্নিত করতে হয় তাহলে সেই পুণ্যশ্লোক নামটি বলতে হবে মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী।

যদিও “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” ১৮৮৯ সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়েছিল তবে স্কুলগত প্রাণ ও মেধাবী মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী ভালো করেই জানতেন কি করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হয়। আমার পিতার মতে কালীগঞ্জে একটি ইংরেজি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার কথাবার্তা ১৮৮৫ ও ১৮৮৬ সন থেকেই শুরু হয় এবং হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার মূল নেতৃত্ব ছিল মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীকে ঘিরে। কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবার পূর্বেই বিচক্ষণ মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী ১৮৮৭ সালেই কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলে সপ্তম শ্রেণী ও অষ্টম শ্রেণী খুলে দেন। তাঁর দূরদর্শিতার কারণেই ১৮৮৮ সালে স্কুলটিতে নবম শ্রেণী খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৮৮৯ সালে দশম শ্রেণীও যুক্ত করা হয়। আলাদা করে কালীগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি  বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানীয় মুন্সেফপুর গ্রামের অতি ধুরন্ধর ও ক্ষমতাশালী তালুকদার উমেশ ধর কোন উপযুক্ত স্থানে জমি প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানানোর পরেই স্থানীয় “কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলটিকে” উন্নীত করে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” স্থাপন করা হয়।

আমি আজ ১৩১ বছর পর অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি যে মান্যবর মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর একক নেতৃত্বেই কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল তড়িৎগতিতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ধীন প্রবেশিকা মানের মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে “স্বীকৃতি” পেয়েছিলো এবং ১৮৯০ সনেই তৎকালীন এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। যে কোনো মানদন্ডে বিচার করলে বলতে হয় যে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” প্রতিষ্ঠাতে নিবেদিত প্রাণ মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর নেতৃত্ব ছিল অপরিহার্য এবং তাঁর নেতৃত্ব এতই দৃঢ়,স্পষ্ট ও গ্রন্থিল ছিল যে তাঁর আহবানে কালীগঞ্জ এলাকার ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম-গঞ্জের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কালীগঞ্জে ইংরেজি হাই স্কুলটি স্থাপনে এগিয়ে আসেন। আমি এই ঐতিহ্যবাহী স্কুলের একজন নগন্য প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে নমস্কারাদি জানায়ে সৌজন্য প্রদর্শন করে শ্রদ্বাঞ্জলি জানাচ্ছি তাঁদেরকে যাঁরা মাননীয় সিংহ-হৃদয় মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে কালীগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আমার পিতার কাছে শুনেছি যে ১৮৮৮ সাল থেকেই নাকি মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর বদলির আদেশ আসছিলো এবং তিনি অতি বিনয়ের সাথে একাধিকবার তাঁর বদলির আদেশ স্থগিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আমার প্রয়াত পিতা বলেছিলেন যে একটি গবেষণামুলুক প্রবন্ধ লেখার মানসে ১৯১৩ সালের গোড়ার দিকে তিনি যখন একাধিক গন্যমান্য ব্যক্তির (শ্রীযুক্ত উমেশ ধর সহ অন্য আরো কয়েকজন) সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই নাকি বলেছিলেন যে মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কালীগঞ্জে একটি ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে কালীগঞ্জ ত্যাগ করতে চান নাই। এই ব্যাপারে তিনি সফলকম হয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালের জানুয়ারী মাসেই তিনি “কালীগঞ্জ ইংলিশ হাই স্কুল” প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ঠিক এক বছরের মধ্যেই  ১৮৯০ সনে বদলি হয়ে তিনি অন্যত্র চলে যান। আজ আমি স্মরণ করছি তাঁর মতো একজন ক্ষণজন্মা পুরুষের কর্তব্যপরায়ণতা ও বিদুৎসাহিতা।

মাত্র তিন/চার সপ্তাহ পূর্বে ফেইসবুক সন্নিবেশিত আমার লেখা বাংলা প্রবন্ধে (“কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ: প্রশ্নোত্তরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার গোড়ার দিকের ইতিবৃত”) আমি বলেছি যে আমাদের স্কুলের আদি নাম বা প্রারম্ভিক নাম নিয়ে কোনো বিভ্রাট নাই বা থাকতে পারে না। এই কোথাও বলেছি যে “কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলকেই”  উন্নীত করে ১৮৮৯ সালে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” করা হয়েছিল। শত চেষ্টা করেও “কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলটিকে” রক্ষা করে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল যে স্কুলটি করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান উপযুক্ত জমি না পাওয়া এবং যথেষ্ট অংকের তহবিলের অভাবে সম্পূর্ণ নুতন করে আলাদাভাবে একটি প্রবেশিকা মানের হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপন করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিলো। তবে তড়িৎকর্মা মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কালীগঞ্জে একটি পূর্ণাঙ্গ ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন এবং ক্ষণজন্মা পুরুষ বিপদে হাল ছেড়ে দিতে চান নি। শতরকম বৈরী পরিপ্রেক্ষিতেও “কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলের” বুকের উপরে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। মোদ্দা কথা হলো এই যে ১৮৮৯ সালের শুরুতেই “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে “কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলের” বিলুপ্তি ঘটে”।

কালীগঞ্জবাসীদের জন্য মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন সেই জন্য তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। তাই আমার অতিপ্রিয় কবি শামসুর রহমানের কথা দিয়ে (পুরো লাইন এই মুহর্তে আমার স্মরণে আসছেনা) মাননীয় মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কাছে আমার ও আমাদের এলাকাবাসীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি: “আপনার ঋণ যেন জন্মের দাগ, ভুলবোনা কোনোদিন”।

কে বা কারা কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপন করার খরচপত্র বহন করেছিল? 

কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপন করার খরচপত্র বহন করার জন্য কোনো একক উপকারসাধণেব্রতী ব্যক্তি ছিল না। কারুর মহানুভবতায় সৃষ্ট লোকহিতার্থ দান বা দাতব্য বৃত্তি দিয়েও কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি স্থাপন করা হয়নি। জোর  করে কোনো চাঁদাবাজি করে টাকা আদায় করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়নি। বলতে গেলে কালীগঞ্জ ও আশেপাশের সকল নেতৃস্থানীয় ও সচ্ছল ব্যক্তিদের সঙ্গে আমজনতাও হাই স্কুলটি গড়ে তোলার জন্য স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। আমার পিতা বলে গেছেন যে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, স্থানীয় ও বিভিন্ন এলাকার কিছু বিদ্যুৎসাহী তালুকদার, জোতদার, মহাজন, বিভিন্ন সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রতিনিধিবৃন্দ, স্থানীয় ধনী ব্যবসায়ী, কয়েকজন সাহা ও মাড়োয়ারি পরিবার ও কালীগঞ্জ বাজারের সাধারণ ব্যবসাহী ও দোকানের মালিকরা কালীগঞ্জ ইংরেজি হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করার খরচ বহন করেছিল। এছাড়া আমাদের এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী ও চাকুরীজিবিরা স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উদারহস্তে দান করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের সকল উকিল, মোক্তার, মুন্সি, পেশকার, মুহুরী, কেরানি ও আর্দালিসহ সবাই নিজ নিজ উদ্যোগে যাঁর যাঁর সাধ্যানুযায়ী স্কুল ফান্ডে দান করেছিলেন। স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রার ও তাঁর অফিসের কর্মচারীবৃন্দ ও দলিল লেখকরাও স্কুল ফান্ডে টাকা প্রদান করেছিল।

আমার পিতার ভাষ্য অনুযায়ী অতি সাধারণ হিন্দু-মুসলমান গৃহস্থ ও আমজনতার মধ্যেও কেউ কেউ স্কুল ফান্ডে টাকা দান করেছিলেন। তবে তিনি এই কথাও বলেছেন যে সাধারণ লোকের মধ্যে যাঁদের ছেলেরা কালীগঞ্জ মিডল ইংলিশ স্কুলের ছাত্র ছিল তাঁরাই কালীগঞ্জ হাই ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সবচেযে বেশি উৎসাহী সমর্থক ছিল। আমার পিতার মুখে আরো শুনেছি যে নিবেদিত প্রাণ মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক খরচপত্র স্বেচ্ছায় নিজেই বহন করেছিলেন।

১৮৮৮-১৮৮৯ সালে ঢাকা জিলার তৎকালীন কাপাসিয়া থানা কতটুকু বিস্তৃত ছিল?

কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপনের গুরুত্ব বুঝবার জন্য কালীগঞ্জ-কাপাসিয়ার থানা তথা ভাওয়াল পরগনার পরিধি সম্মন্দে ধারণা থাকা প্রয়োজন। ১৮৮৮ -১৮৮৯ সালে কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীরই ছিলেন অত্র অঞ্চলে তথা কাপাসিয়া থানার সমগ্র এলাকার মধ্যে সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা। এলাকাটা সত্যিই অনেক বিস্তৃত ছিল কারণ সেই সময় ঢাকা জিলার ঢাকা সদর মহকুমার অন্তর্গত কাপাসিয়া থানার চৌহদ্দিতে নিম্নলিখিত বিখ্যাত স্থানগুলি ছিল: “কাপাসিয়া, কড়িহাতা, সিঙ্গারদীঘি, লাখপুর, মামুদপুর, পারুলিয়া, কালীগঞ্জ, ব্রাহ্মণগাঁও, বলধা, ঘাগটিয়া, বর্মী, শ্রীপুর, উলসারা, ধনদিয়া, কাওরাইদ, টোকচাঁদপুর, ঘোড়াশাল, জাঙ্গালীয়া, বক্তারপুর, গোসিংগা, খোদাদিয়া, সম্মানিয়া, টোকনগর, রাথুরা, কান্দোনিয়া, একডালা, ধলজুড়ি, বালিগাঁও, বরাব, চরসিন্দুর প্রভৃতি” (দেখুন, যতীন্দ্রমোহন রায় প্রণীত: ‘ঢাকার ইতিহাস’, প্রথম & দ্বিতীয় খন্ড, বইপত্র, বাংলাবাজার, ঢাকা. পৃষ্ঠা নাম্বার: ১১৫)।

আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি যে আমাদের স্কুলটি যখন স্থাপিত হয় তখন ভাওয়ালের অন্তর্গত অনেক এলাকা কেরানীগঞ্জ থানার অধীনে ছিল এবং এই কথাটা উদ্ভট লাগলেও আমার কথাটা সত্যি। তবে এসব এলাকার বেশিরভাগ লোকেরা জমিজমা সংক্রান্ত মামলা-মোকাদ্দমার জন্য কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের উপরে নির্ভর করতো। তাছাড়া থানা বা পুলিশ সংক্রান্ত ব্যাপারে সুদূরে অবস্থিত কেরানীগঞ্জ থানায় দৌড়াদোড়ি করতে ভুক্তভোগীদের অমানবিক যন্ত্রনা সহ্য করতে হতো। তাই এখানে এই কথাও উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে তৎকালে ভাওয়ালের জয়দেবপুরসহ আশেপাশের সুবৃস্তিত এলাকা ছিল সুদূরে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত কেরানীগঞ্জ থানার অন্তর্গত। উদাহরণস্বরূপ কেরানীগঞ্জ থানার শুধু নিম্নলিখিত কয়েকটি স্থানের নামগুলি ঢাকা জিলাৰ ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে ধরছি: মিরপুর, ডেমরা, মাতাইল, কুর্মিটোলা, টঙ্গী, বোয়ালী, গাছা, জয়দেপুর, রাজেন্দ্রপুর, পুবাইল, দক্ষিণ খান, ধীরাশ্রম, হায়দ্রাবাদ, খাইকুড়ি প্রভৃতি” (আমার কথা বিশ্বাস হউক বা না হোক সময় করে দেখে নিন: যতীন্দ্রমোহন রায় প্রণীত: ‘ঢাকার ইতিহাস’, প্রথম & দ্বিতীয় খন্ড, বইপত্র, বাংলাবাজার, ঢাকা. পৃষ্ঠা নাম্বার: ১১৫)। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার বলা দরকার যে, “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” শুধু তৎকালীন কাপাসিয়া থানার অধিবাসীদের জন্য স্থাপন করা হয়নি। বরং তৎকালীন বৃহত্তর কেরানীগঞ্জ থানাধীন জয়দেবপুর, ধীরাশ্রম, টঙ্গী, বসুগাঁও, পুবাইল, দক্ষিণখান এলাকার অধিবাসীরাও কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” আবির্ভাবে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। এছাড়াও কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব ঢাকা জিলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জ থানা, রায়পুরা থানা, আড়াইহাজার থানা ও বৈদ্যেরবাজার এলাকার লোকজনকে স্কুল স্থাপন করে শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহিত এবং প্রভাবিত করেছিল।

আশেপাশের এলাকার জন্য “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল” ছিল শিক্ষার আলোকবর্তিকা  

এই কথা অনিস্বীকার্য যে অগ্রগামী কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও সফলতা বিভিন্ন এলাকায় উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেছিল। সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা হলো এই যে “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল”একধরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠার সাফল্য দেখে বিভিন্ন এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত বোধ করেন। অনেক বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তিরা নাকি বলতো যে  “কালিগঞ্জবাসী ইংরেজি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমরাও উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনে সফলকাম হবো”।

আমার পিতার মুখে বহুবার শুনেছি যে বিশেষকরে অনেক স্বচ্ছল ও বিত্তশালী লোক বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা করতে আগ্রহী হন। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল’এর এই রকম ধরণের শিক্ষা প্রসারে অগ্রগামী ভূমিকা ও অবদান অবহেলা করার বিষয় নয়।

শুধু উদাহরণ স্বরূপ বলছি যে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার মাত্র ৮ বছর পরে আড়াইহাজার হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কালীগঞ্জ থেকে এগারো মাইল দূরে নরসিংদীতে ১৯০১ সালে গড়ে উঠেছিল সাটিরপাড়া কালীকুমার (K K K.) ইনস্টিটিউশন। কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের সফলতা ও জনপ্রিয়তা দেখে কালীগঞ্জ থেকে ৮ কিংবা ৯ মাইল দূরে রূপগঞ্জের অতি কাছে মুড়াপাড়ার গন্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ  ১৯০১ সালে গড়ে তুলেছিল মুড়াপাড়া  হাই ইংলিশ স্কুল। কালিগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের সফলতা দেখেই তৎকালীন কেরানীগঞ্জ থানার অন্তর্গত ভাওয়ালের শাসনকেন্দ্র জয়দেবপুরে ১৯০৫ সালে রানী বিলাসমনি নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেন “রানী বিলাসমনি হাই ইংলিশ স্কুল।

এন্ট্রান্স ও মেট্রিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে যাঁরা নব-প্রতিষ্ঠিত কালীগঞ্জ ইংরেজি হাই স্কুলের নাম উজ্জ্বল করে ছিলেন

আমার গুরু-গৃহ কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ পাইলট হাই স্কুলে আমি নিজে ও আমার সতীর্থরা সুযোগ্য শিক্ষকমন্ডলীর কাছে পড়েছি ১৯৫৯ সালের  একদম শুরু থেকে ১৯৬৫ সালের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। আমি আমার ঐতিহ্যময় স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে গর্ববোধ করি। মনে মনে শুধু ভাবি যে এই সেই ‘এক রত্তি’ পরিমান ইংরেজি হাই  স্কুল যেখান থেকে ১৮৯০ সালে বিশ বছর বয়েসী একমাত্র ছাত্র যাঁর নাম ছিল *রেবতীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়* যিনি তৃতীয় বিভাগে কলিকাতা বিশবিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেছিলেন। তিনিই ছিলেন আমাদের স্কুলটির সর্ব প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য ছাত্র। যিনি নব প্রতিঠিত ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন। তার পরের বছরেও ১৮৯১ সনে আমাদের স্কুল থেকে *যামিনীনাথ চৌধুরী* নামে একমাত্র ছাত্র তৃতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। কাগজেপত্রে তখন তাঁর বয়স লেখা ছিল ১৪ বছর দুই মাস। তিনি ছিলেন আমাদের স্কুলের দ্বিতীয় কৃতকার্য ছাত্র যিনি এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে নব-প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি হাই স্কুলের নাম উজ্জ্বল করে ছিলেন। তার পরের বছর ১৮৯২ সাল থেকে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের ছাত্রদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলাফল ভালো হতে শুরু করে এবং তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৮৯০ থেকে ১৯০৯ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমাদের স্কুলের ছাত্রদের ফলাফল আমি সংগ্রহ করেছি। আমাদের স্কুলের সমসাময়িক স্কুলের সঙ্গে (উদাহরণ স্বরূপ: ভাঙ্গা হাই ইংলিশ স্কুল, বাজিতপুর হাই ইংলিশ স্কুল, আড়াইহাজার হাই ইংলিশ স্কুল, নবীনগর হাই ইংলিশ স্কুল, সাটিরপাড়া কালীকুমার ইনস্টিটিউশন, মুড়াপাড়া হাই ইংলিশ স্কুল ও উজানচর হাই ইংলিশ স্কুল) আমাদের স্কুলের ছাত্রদের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফল তুলনা করে দেখেছি যে আমাদের স্কুলের ছাত্ররা প্রবেশিকা পরীক্ষায় অনেক ভালো করেছিল।

১৯১০ সাল থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত আমাদের স্কুলের ছাত্রদের যাঁরা মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছিলেন তাঁদের ফলাফল আমি লিপিবদ্ব করতে পেরেছি। আমি মনে করি পূর্ববাংলার নামকরা অন্নান্য বেশ কয়েকটা গ্রামীণ হাই ইংলিশ স্কুলের সঙ্গে তুলনামুলুক আমাদের স্কুলের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল ছিল অনেক উন্নত মানের।

কে ছিলেন মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী ? কি ছিল তাঁর পরিচয়? কি ছিল তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা?

আমার পিতা এই সম্পর্কে বলেছেন তবে আমার সঠিক মনে নেই। এতটুকু মনে করতে পারি যে মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী নাকি ছাত্র জীবনে খুবই মেধাবী  ছাত্র ছিলেন। কোথায় তিনি লেখাপড়া করেছিলেন তা জানা নেই। যতটুকু জানি মাননীয় মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী বি.এ.পাশ ছিলেন। বোধকরি তিনি কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেছিলেন। আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটির একাডেমিক ক্যালেন্ডারগুলি তন্নতন্ন করে  ঘেটে দেখেছি যে “কালীকৃষ্ণ চৌধুরী” নামে মাত্র একটি মাত্র ব্যক্তিই বি.এ.পাশ করেছিল এবং তাঁর বি.এ পাশ করার সাল ছিল ১৮৬৮। (*তবে আমি কিন্তু  সঠিক করে জানিনা এই কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কি আমাদের মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কিনা)।

কখন মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কালীগঞ্জ ত্যাগ করেছিলেন? কালীগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে কোথায় তিনি গিয়েছিলেন? আমি আমার পিতার মুখে শুনেছিলাম  যে মুনসেফ বাবু কালীকৃষ্ণ চৌধুরী আমাদের স্কুল প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ১ বছর পরে অর্থাৎ ১৮৯০ সালের গোড়ার দিকে জানুয়ারী মাসেই বদলী হয়ে অন্য জায়গায় চলে যান। তবে ১৮৯৬ সালে উড়িষ্যার পুরী শহরে সিনিয়র মুনসেফ হিসেবে চাকুরীরত ছিলেন। এই বছরের গোড়ার দিকে আমি গুগলে সার্চ মারফত এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পেরেছি।

সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর নামটি কালীগঞ্জের স্মৃতি থেকে অতীতের গহব্বরে হারায়ে যায়:

মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর জীবন বৃত্তান্ত আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি। তবে ঐসবের অনেক কিছুই আজ আর মনে নেই। আমার পিতার মুখ থেকেই তাঁর অনেক গুণাবলীর ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম। কর্মবীর কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর একাগ্রতা, উদারতা ও পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি স্থাপিত হলেও তাঁর নামটি মনে হয় চিরদিনের জন্য মুছে গেছে। আমার পিতার কাছে শুনেছি যে আমাদের স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বা ৩০  বছর পরেও সাধারণ লোকদের মুখে তাঁর পুণ্যশ্লোক নামটি অতি শ্রদ্বার সঙ্গেই উচ্চারিত হতো।

নিরলস কর্মযোগী মাননীয় মুনসেফ বাবু কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নামটি আমরা স্মরণ করিনা। কালীগঞ্জ হাই স্কুলের মতো উঁচু মানের ইংরেজি হাই স্কুল যাঁর বদান্যতায় স্থাপিত হয়েছিল সেই নিরহংকারী ও মহান ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে গেলে আমরা কিছুই জানিনা। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করার এক বৎসর পরেই ১৮৯০ সালের প্রথম দিকেই তাঁকে কালীগঞ্জ ত্যাগ করতে হয়েছিল। তাঁর কালীগঞ্জ ত্যাগের ১৩০ বছর পরও কোনো লেখক এই মহান ব্যক্তির সম্পর্কে কিছুই লেখেনি। আমার জানা মতে তাঁর উপর কোনো জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়নি।

মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী যে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের মূল প্রতিষ্ঠাতা সেই কথা আমার পিতা একটি প্রবন্ধে লিখে যাওয়াতে আমরা তাঁর নামটি আজকে উল্লেখ করছি। আমার পিতার মুখে আরো শুনেছি যে সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর নামটি কালীগঞ্জের স্মৃতি থেকে অতীতের গহব্বরে হারায়ে যায়। আমার পিতা বলছেন যে তিনি যদি ছাত্রাবস্থায় ১৯১৩ সালে “শ্রীযুক্ত কবি কালিভূষণ মুখোপাধ্যায়” নামক প্রবন্দটি না লিখতেন তাহলে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী সম্বন্দে এতকিছু জানতেন না। কারণ আমার পিতার জন্মের ঠিক চার বৎসর পূর্বে ১৮৯০ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকেই মান্যবর মুনসেফ জনহিতৌষী কালীকৃষ্ণ চৌধুরী কালীগঞ্জ ইংরেজি হাই স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক ও তাঁদের শুভাকাঙ্খী ও অত্র এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-জনতা বিশেষ করে আমাদের এলাকার শোষিত প্রজা ও বঞ্চিত রায়তদেরকে চোখের পানিতে ভাসায়ে কালীগঞ্জ ত্যাগ করেছিলেন।

এছাড়া “কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের” নাম যেহেতু ১৯০২ সাল থেকেই “কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই ইংলিশ স্কুল” হয়ে গিয়েছিলো এবং সেই সময় থেকেই স্কুলটি এই নামেই পরিচিতি পেয়ে আসছে সেই জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে করে আসছে যে ভাওয়ালের জমিদার রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণই  কালীগঞ্জ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।

মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর সম্পর্কে আমার পিতার কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনে ছিলাম। তিনি কালিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে অতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন। তবে ঐসবের অনেক কিছুই আজ আর মনে নেই। আমার পিতার মুখ থেকেই তাঁদের অনেক গুণাবলীর ও চরিত্র বৈশিষ্টের সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম। আমি হয়তোবা অকালপরিপক্ক ছিলাম বলেই এত বছর পরও অনেক কিছু স্মরণ করতে পারছি। স্থানের দূরত্বে বা সময়ের ব্যবধানে সেই সব ফেলে আসা  দিনরাত্রির ও আলাপচারিতার অমূল্য স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়নি।

আমি আমার ইতিহাস-প্রেমী পিতার কাছ থেকে শুনেছি শ্রদ্ধাস্পদ মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী ছিলেন আলোকিত মানুষ এবং তিনি মর্মে মর্মে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন যে কালীগঞ্জে একটি উঁচু মানের উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই অত্র এলাকার বালক ও কিশোরেরা আধুনিক শিক্ষায়  শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে I আমার পিতার মুখে শুনেছি যে কালীগঞ্জে একটি উচ্চ ইংরেজি  বিদ্যালয় স্থাপন করা অমায়ীক ভদ্রলোক মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর সস্নেহে  লালন করা একটি আকাঙ্খায় পরিণত হয়েছিল। তাঁর ছিল বিজ্ঞান মনস্কতা। তিনি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখতেন যে নব প্রতিষ্ঠিত কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল পরবর্তীকালে ঢাকা জেলার অত্র এলাকায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার আলোবিস্তারে ব্যাপক, গুরুত্বপূর্ণ ও  ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে। আমার বড়ই আফসোস এই যে এতো বড় মাপের মানুষটির নামটি পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে। অনেকে রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণকে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বলে চালায়ে দিতে চায়। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আমাদের স্কুলের ১২৫ বৎসর উদযাপন কমিটির কেউ কেউ রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণকে আমাদের স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলো। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলো যে উদযাপন কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ছাত্রসুহৃদ নামক স্মারকগ্রন্থেই পরিষ্কার করে লেখা আছে যে মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর পুরোহিত্যে ১৮৮৯ সালে ‘কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও একমাত্র আমার পিতার লেখা ১৯১৩ সালের প্রবন্ধটিতেই এইসব কথাবার্তা লেখা আছে এবং ঐ প্রবন্দটি তাদের ছাত্র-সুহৃদ নামক সংকলনে না ছাপিয়ে বিজ্ঞ পন্ডিতবর্গ তা থেকেই তাদের সংকলনে ঝুটা ঝুটি এবং কাটাকাটি করে বিভিন্ন অনুচ্ছেদ তুলে দিয়েছিলো। তা সত্ত্বেও তাদের স্বারকগ্রন্থে প্রবন্ধটির নাম (“সুকবি কালিভূষণ মুখোপাধ্যায়”) বা প্রবন্ধ লেখকের নাম (“শ্রী বদরুজ্জামান”) উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে নাই। এই জঘন্য ও নিষ্ঠূর কাজটা যে চৌর্য্যবৃত্তি সেই কথাও তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো।

২০১৪ সালের ছাত্র-সুহৃদ নামক স্মারকগ্রন্থের বিজ্ঞ মুরুব্বিরা অবশ্য একটি কাল্পনিক কথা জুড়ে দিয়ে বললো যে প্রজ্ঞাবান ও আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মাননীয় মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী নাকি রাণীমাতা রানী “বিলাসমনির প্রেরণায় ১৮৮৯ সালে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলটি স্থাপিত করেছিলেন”। আজ খোলা ময়দানে এমন নীচু ধরনের মিথ্যাচারের ও দমবাজী কথাবার্তার তীব্র্র প্রতিবাদ করছি। আজ আমাকে এখানেই ইতি টেনে উপসংহারে কিছু কথা বলে শেষ করবো। (এখানে চৌযুবৃত্তির নিয়ে কথা না বাড়িয়ে শুধু বলব যে এই সম্পর্কে আলাদা  করে কিছু লিখতে পারবো বলে আশা পোষণ করছি)।

উপসংহার 

অতি বিনীত সুরে আমার লেখার হৃদয়বান পাঠকদের জানাতে চাই যে নিঃসন্দেহে এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটি আমার গুরুগৃহের অতীতকে নিয়ে লেখা এবং এ থেকে আপনারা অতীতের অনেক না জানা বা বিস্মৃত কথা জানতে পারবেন।  তবে অতীতকে জানবার বা অতীতকে নিয়ে ভাববার জন্য শুধু নয়, সারা দেশে বর্তমানের শিক্ষাঙ্গনগুলিতে নৈরাজ্যমুলুক পরিস্থিতি ও ইদানিংকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত অনুধাবন করার জন্যও আমাদেরকে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার প্রয়োজন আছে। এমনকি আমাদের ভবিষ্যতের সঠিক পন্থা ও বাস্তব রূপরেখা প্রণয়নের প্রয়োজনেও আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের মতো অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতীত ঘটনাবলীর পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিঃসন্দেহে আজকাল ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ ও এমপিও ভুক্তিকরণের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় নুতন মাত্রা যোগ হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চা একশত বছর আগে যে তিমিরে ছিল এখনো সেই তিমিরেই নিমজ্জিত আছে। (***তবে আমি নিজ উদ্যোগে ক্ষুদ্রাকারে আমাদের এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রহ করার কাজে মনোনিবেশ করার পরিকল্পনা করছি। সময়ের স্বল্পতা আছে যেহেতু আমি এখনো পূর্ণভাবে আমার অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত আছি। এই আকাঙ্খা পূরণে কতটুকু কৃতকার্য হতে পারবো তা জানিনা। তবে এই মহতী কাজটির বাস্তবায়ন হবে সম্পূর্ণভাবে অরাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে এবং স্থানীয় রাজনীতি-মুক্ত।)

কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুলের উদ্ভব ও বিকাশের মাধমেই আমাদের এলাকায় আধুনিক শিক্ষার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল।নির্ভরশীল তথ্য-উপাত্ত মোতাবেক তৎকালীন কালীগঞ্জ মুনসেফ কোর্টের জনদরদী ও বিদ্যুৎসাহী মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী মহাশয়ের উৎসাহ, উদ্দীপনায় ও দৃঢ় নেতৃত্বে কালীগঞ্জের স্থানীয় গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ কালীগঞ্জে এই ইংরেজি মাধ্যমিক বা উচ্চ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিল। আমাদের স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ১২৫ বছর বা ১৩১ বছর পর কেউ যদি মনের মাধুরী লাগায়ে কাল্পনিক ভাবে ধার করা বুলি চাপকায়ে দাবি করে যে “কালী নারায়ণের পুত্র রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী রানী বিলাসমনির প্রেরণায় ১৮৮৯ ইং সালে কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল স্থাপিত হয়েছিল” তাহলে তা হবে মিথ্যাচার। এমন ধরণের সত্য বিবর্জিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঐতিহ্যনাশী কথাবার্তা হলো ত্রূটিপূর্ণ ও কল্পনাপ্রসূত। আমাদের স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ১২৫ বছর উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ‘ছাত্র-সুহৃদ’ নামক স্মারকগ্রন্থে এসব মনগড়া কল্পকাহিনী জুড়ে দিয়ে যে সব স্বপ্রশংসিত বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এই স্মারকগ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তারা নিজেরাই ইতিহাস বিকৃতির ধারক ও বাহক হয়ে গেলেন।

রানী বিলাসমনি তো দূরের কথা স্বয়ং তাঁর স্বামী রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের নাম কালীগঞ্জে উচ্চ ইংরেজি স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জড়িত ছিলোনা। আমার পিতার মুখে শুনেছি মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরী ছিলেন আলোকিত মানুষ এবং তিনি মর্মে মর্মে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন যে কালীগঞ্জে একটি উঁচু মানের উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই অত্র এলাকার বালক ও কিশোরেরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে। আমার পিতার মুখে শুনেছি যে  কালীগঞ্জে একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করা অমায়ীক ভদ্রলোক মুনসেফ কালীকৃষ্ণ চৌধুরীর সস্নেহে লালন করা একটি আকাঙ্খায় পরিণত হয়েছিল। তাঁর ছিল বিজ্ঞান মনস্কতা। তিনি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখতেন যে নব প্রতিষ্ঠিত কালীগঞ্জ হাই ইংলিশ স্কুল পরবর্তীকালে ঢাকা জিলার অত্র এলাকায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার আলোবিস্তারে ব্যাপক, গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে। বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে তাঁর নামটি পর্যন্ত বিলীন হয়ে  গেছে।

আমার অতি প্রিয় কালিগঞ্জবাসী ও সুহৃদ পাঠক, আমি জানি আমাদের কালীগঞ্জ হাই স্কুলের সুদীর্ঘ অতীত সম্পর্কে আপনাদের অনেক প্রশ্ন আছে। সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারছিনা আপনাদের অনেকের মতো আমিও সব প্রশ্নের উত্তর জানিনা। তবে (আমার পিতার ভাষায়ই বলতে চেষ্টা করছি) আমার জন্মদাতা ও ত্রাতা স্বর্ণপ্রসবিনী ভাওয়াল পরগনাস্থ বর্তমান কালীগঞ্জ উপজিলার অন্তঃপাতী সাং উত্তর ভাদার্ত্তী নিবাসী প্রয়াত মৌলভী বদরুজ্জামান মাস্টার যিনি এসব জাতীয় প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারতেন। কিন্তু তিনিতো ‘এই দুনিয়া’, ছেড়ে চলে গেছেন সেই বহু বছর আগে– ১৯৭৫ সালের মে মাসের পাঁচ তারিখে। যাহোক তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তাঁর সাথেই আলাপচারিতায় অনেক কিছু জানতে পারতাম। তবে এই কোমল হৃদয়ের নিবেদিত আলোকিত মানুষটি যাঁর সারাটা জীবনই ছিল স্বল্পতার বেড়াজালে অষ্টপাস্টে বেষ্টিত হয়তো বুঝতে পারতেন যে  এই  দুনিয়াটা বদলে গেছে I মানুষের  মুল্যবোধও  বদলে গেছে।

আমার সংগীত প্রেমী পিতা হয়তো বা গুন্ গুন্ করে মিতালী মুখার্জীর গাওয়া গানটি গাইতেন: “এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই …মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই…এই দুনিয়া এখন তো আরসেই দুনিয়া নাই,মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাইএই মানুষের ভিরে আমার সেই মানুষ নাই। এই দুনিয়া এখন তো আরএই মাটির দেহ খাইল ঘুণেদেখলো না তো কেউ,সারা জীবন দুই নয়নেরইল জলের ঢেউ, আমার দুঃখের কথা কইতে গেলেএই দুনিয়ার সবাই বলে শোনার সময় নাইএই মানুষের ভিরে আমার সেই মানুষ নাই। এই দুনিয়া এখন তো আরহায় এখন বুঝি দারুন সময়বদলে গেছে দিন,কেউ আমারে চায় না দিতে একটু সময় ঋণ। আমার মনের বাগান রইল খালিসেই বাগানের সুজন মালি বলো কোথায় পাইএই মানুষের ভিরে আমার সেই মানুষ নাই।“

লেখক : অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মানিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন বিভাগ, অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটি, ক্লারক্সভিল, টেনেসি।

 

আরো জানতে…….

বস্ত্র শিল্পের এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মসলিন কটন মিল’

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button