গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কোনো পলাতক বা দণ্ডিত আসামির বক্তব্য প্রচার করতে পারবেনা দেশের সংবাদমাধ্যম। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে পিকে হালদারের সাক্ষাৎকার প্রচার নিয়ে দুদকের আবেদনে হাইকোর্ট এই আদেশ দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে কিনা। যারা এটা মনে করেন তারা বলছেন, ‘‘ওই ধরনের সাক্ষাৎকার নেয়া সারাবিশ্বে সাংবাদিকতায় স্বীকৃত। সাংবাদিকরা বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এটা করে অতীতে অনেক বাহবা পেয়েছেন।”
সোমবার ৭১ টেলিভিশন প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) সাক্ষাৎকার প্রচার করে। পরে ওই টকশোতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমকেও সংযুক্ত করা হয়। তিনি এক পর্যায়ে পলাতক আসামির সঙ্গে টকশো করবেন না বলে বের হয়ে যান।
এই পরিস্থিতিতে দুদকের আবেদনে বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল বেঞ্চ পিকে হালদারের সাক্ষাৎকার প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেন। আদালত টকশোর ভিডিও ক্লিপও তলব করেছেন যা ১০ জানুয়ারির মধ্যে জমা দিতে হবে।
একইসঙ্গে পিকে হালদারসহ যে কোনো দণ্ডিত ও পলাতক আসামির বক্তব্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার-সম্প্রচারে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। রুল নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।
বিষয়টি দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমও নিশ্চিত করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আদালতের আদেশ হলো কোনো মামলার আসামি বা দণ্ডিতের কোনো ধরনের বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। যারা পলাতক, যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে তাদের বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে বিচার প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।’’
অবশ্য সিনিয়র সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘এধরনের সাক্ষাৎকার সারা দুনিয়ায় নেয়া হয়৷ সাংবাদিকদের কাজ এট। আর এতে বিচার প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ বিচারকরা প্রভাবিত হবেন কেন?’’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীন এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ডিজিটাল আইনসহ আরো অনেক বাধা আছে। সাংবাদিকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিও একটি কারণ। এখন নতুন একটি বাধা যুক্ত হলো। সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় ফোর্থ এস্টেট। এভাবে হলে ফোর্থ এস্টেট অকার্যকর হয়ে যাবে৷ বিচারকেরা হয় এটা মাথায় নিচ্ছেন না অথবা তাদের মাথায় এটা দেয়া হচ্ছে না।
এজন্য বিচারকদের দায়ী না করে তিনি মনে করেন বিষয়টি তাদের কাছে তুলে ধরা দরকার। এটা আদালতে সাংবাদিকেরা পার্টি হয়েও করতে পারেন আবার আলোচনার মাধ্যমেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
পিকে হালদারের সাক্ষাৎকার গ্রণের ক্ষেত্রে সাংবাদিক ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। তিনি পিকে হালদারের কাছে যাননি। কিন্তু পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীর বিশ্বব্যাপী মোস্ট ওয়ান্টেড ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তার আস্তানায় গিয়ে। আগে বাংলাদেশি সাংবাদিকেরাও পলাতক জঙ্গি বা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
এধরনের উদাহরণ টেনে গাজী টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘‘আমার কাছে মনে হয়েছে আদালতের আদেশটি ঢালাও হয়ে গেছে। সারা দুনিয়াতেই সাংবাদিকেরা এটা করেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এটা অপরিহার্য। সাংবাদিকেরা পলাতক আসামি বা অপরাধীকে ধরে নিশ্চয়ই পুলিশের কাছে দেবেন না। তাদের যা কাজ তাই করবেন। বরং আদালতের কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাহবা দেয়া উচিত এই বলে যে, সাংবাদিকেরা পায় পুলিশ কেন পায় না।”
তিনি মনে করেন, দণ্ডিত আসামীর ব্যাপারে সাংবাদিকেরা কৌশল করতে পারেন। কিন্তু যার দণ্ড হয়নি সেরকম পলাতক আসামীর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা যথার্থ মনে হয়নি। তাই তিনি সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বিষয়টি আদালতের কাছে তুলে ধরা উচিত বলে মনে করেন।
এজন্য সাংবাদিকদেরও দায় আছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘‘তারেক রহমানের ব্যাপারে যখন একই ধরনের আদেশ দেয়া হয়েছিল তখন সাংবাদিকরা কোনো কথা বলেননি। সরকারের পক্ষ থেকেও এধরনের আদেশে উৎসাহ দেয়া হয়েছে তখন। আর সেই আদেশের রেফারেন্সই পিকে হালদারের ক্ষেত্রে দেয়া হয়েছে।”
অবশ্য তিনি মনে করেন, ওসামা বিন লাদেন বা কোনে পলাতক আসামির সাক্ষাৎকার যেভাবে অতীতে নেয়া হয়েছে তার সাথে পিকে হালদারের সাক্ষাৎকারের পার্থক্য আছে। সেখানে এককভাবে তাদের কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু পিকে হালদারে ক্ষেত্রে আসামি, বাদীর আইনজীবী সবাইকে সংযুক্ত করা হয়েছে। একটা সাবজুডিস ম্যাটার নিয়ে কথা বলা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এখানে বিচার প্রভাবিত হতে পারে তাই তিনি মনে করেন, ‘‘বিষয়গুলো আলাদাভাবে দেখে, বিবেচনা করে প্রতিটি বিষয়ে সাংবাদিকদের আইন-কানুন মাথায় রেখে কৌশল নির্ধারণ করা দরকার।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে