জাতীয়

রাসেল হত্যার মত নৃশংসতা যেন আর না ঘটে সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার : প্রধানমন্ত্রী

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের নির্মম হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ ধরনের নৃশংস ঘটনা আর যাতে না ঘটে সেজন্য তাঁর সরকার শিশুদের জন্য একটি ভবিষ্যৎ রচনায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক সেটাই আমরা চাই।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন। এই স্বাধীনতার সুফল প্রত্যেক ঘরে পৌঁছাবে এবং প্রতিটি শিশু লেখাপড়া শিখে আগামী দিনে এ দেশের কর্ণধার হবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী রোববার (১৮ অক্টোবর) সকালে জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ রাসেলের ৫৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘আজকে রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম। কিন্তু, একটি ফুল কুড়িতেই শেষ হয়ে যায়, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে তাকে নির্মমভাবে চির বিদায় নিতে হয়।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে তাঁর (রাসেলের) বিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ শেখ রাসেলের ‘ম্যুরাল’ উন্মোচন করেন এবং ‘শহীদ শেখ রাসেল ভবন’ উদ্বোধন করেন।

ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানে তিনি শহীদ শেখ রাসেলের ওপর নির্মিত এনিমেটেড ডকুমেন্টারি ‘বুবুর দেশ’-এর প্রদর্শনী এবং শেখ রাসেলের জীবনীর ওপর প্রকাশিত বই ‘শেখ রাসেল আমাদের আবেগ’ এবং ‘স্মৃতির পাতায় শেখ রাসেল’ শীর্ষক দু’টি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন।

শেখ রাসেল শিশু-কিশোর সংসদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে প্রচারিত ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের কার্যক্রম সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র অবলোকন, এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের পুরস্কার বিতরণ, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান এবং দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রমে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানটির সঙ্গে একাধারে প্রধানমন্ত্রীর গণভবন, শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণ এবং বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র সংযুক্ত ছিল।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রান্তে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে কৃতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভিন্ন পুরস্কার ও বৃত্তি প্রদান করেন। শেখ রাসেল অনলাইন দাবা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার এবং সংগঠনটির সাংগঠনিক কর্মকান্ডে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তিনি ল্যাপটপও বিতরণ করেন।

শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. রকিবুর রহমান, মাহমুদুস সামাদ এমপি, কে এম শহীদুল্লাহসহ সংগঠনটির শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সদস্যবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আজকে তাঁর (শেখ রাসেল) স্কুলের সব শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা যে উদ্যোগটা নিয়েছেন, সেখানে রাসেল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী যুগ যুগ ধরে যারা পড়াশোনা করবে তারা এটুকু শিখবে, এইটুকু জানবে যে, একটি ছোট্ট শিশু ছিল এই স্কুলে যে শিশুটিকে বাঁচতে দেয়া হয়নি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শিশুদের জন্য বলবো-আমাদের শিশুরা দেশপ্রেমিক হবে, মানুষের মত মানুষ হবে, মানুষের সেবা করবে এবং নিজেদেরকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। আধুনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হবে।’

তিনি এ সময় করোনাভাইরাসকালীন সতর্কতা হিসেবে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করা এবং শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন, যাতে স্কুল খুললেই সকলে আবার শ্রেণী কার্যক্রমে যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে তিনি অভিভাবকদেরকে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি তাদের মধ্যকার সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ এবং খেলাধুলার সুযোগ করে দেয়ারও আহ্বান জানান।

‘মুজিববর্ষে’ ৫৬তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হচ্ছে শেখ রাসেলের। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ঢাকার বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে ঘাতকের বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অন্য সবার সঙ্গে না ফেরার দেশে চলে যায় সে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি জানি, করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ। এটা সত্যিই যেকোন শিশুর জন্য কষ্টকর। কিন্তু, এমন অস্বাভাবিক অবস্থা থাকবে না। তবুও আমি তাদের বলবো, মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। ঘরে বসে লেখাপড়া করা এবং যারা আর্ট করতে পারে, খেলাধুলা করতে পারে-যে যেটুকু পারে, সেটা তাদের করতে হবে এবং নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতে হবে।

তিনি বলেন, ‘যখনই স্কুল খুলবে তখনই তারা (শিক্ষার্থীরা) যেন স্কুলে যেতে পারে এবং ভালভাবে পড়াশোনা করতে পারে সেদিকে বিশেষভাবে সবাইকে নজর রাখতে হবে।’

‘এজন্য অভিভাবকদেরকেও আমি অনুরোধ করবো- যার যার নিজের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার দিকে মনযোগ দেয়ার এবং খেলাধুলার সুযোগ করে দেয়ার, ’যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এই করোনাভাইরাস থেকে আল্লাহ যেন সবাইকে রক্ষা করেন এবং সবাই যেন সুরক্ষা মেনে চলেন সেটাই আমরা চাই।’

সরকার প্রধান বলেন, ‘বেশি লোক থাকলে আমি নিজেও সেখানে সব সময় মাস্ক পরে থাকি এবং সবাইকে আমি বলবো যেখানেই বেশি লোক সমাগম সেখানে সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সবাইকে মেনে চলতে হবে, শরীরের প্রতি সকলেই যত্ন নেবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা সকলেই পড়াশোনায় মনযোগী হবে। আমার একটাই লক্ষ্য- বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে, এদেশের জন্য ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছে, দুই লাখ মা-বোন যে সম্ভ্রম দিয়েছে, সে কথা সব সময় আমাদের মনে রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই আমাদের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, রোলার স্কেটিং ফেডারেশনকে তাদের চমৎকার ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসবের মধ্যদিয়ে মানুষ রাসেলকে জানতে পারবে, শিশুরা জানতে পারবে। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য যে প্রকাশনা করা হয়েছে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, এদেশের শিশুদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা, দেশ প্রেমিক করা, দেশের সেবা করার মনভাব যাতে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে, তারা যেন সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে, সেদিকে চিন্তা করেই এই সংগঠনটা তৈরি করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, আজকে সারা বাংলাদেশব্যাপী এই সংগঠন, যে সংগঠনের অনেক ছেলেমেয়েই আজকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, অনেকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, অনেকে রাজনীতিতে অবদান রেখে যাচ্ছে।

তিনি শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের সাংগঠনিক কর্মকান্ডের প্রশংসা করে বলেন, ‘তারা প্রতিবছর মেধাবী এসএসসি শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি খেলাধুলা, চিত্রকলা এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ছেলেমেয়েদের মাঝে যে সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে তা ভালভাবে বিকশিত হবারও সুযোগ করে দিচেছ।’ তিনি শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

‘রাসেল’ নামকরণটি তাঁর মা’ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার করা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘আব্বা বার্ট্যান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে, নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখলেন।’

রাসেলের জন্মের সময়টার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘রাসেল যেদিন জন্ম নেয়, সে দিনটির কথাটা এখনো আমার মনে পড়ে। একটা ছোট্ট শিশু আসবে আমাদের পরিবারে, আমি, কামাল, জামাল, রেহানা-আমরা সবাই খুব উৎসাহিত এবং বেশ উত্তেজিত ছিলাম, কখন সেই শিশুটির কান্না আমরা শুনবো, কখন তার আওয়াজটা পাবো, কখন তাকে কোলে তুলে নেবো। আর সেই ক্ষণটা যখন এলো, তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ছিল। ছোট্ট শিশুটি আমাদের সবার চোখের মনি ছিল।’

শিশু রাসেলের মানস পটের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছোট্ট রাসেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা কারাগারে। আমাদের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গিয়েও আব্বাকে বাড়ি চলো বাড়ি চলো বলে কান্নাকাটি করতো। আব্বার সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসার দিনটি রাসেলের খুব কষ্টে কাটতো। সারাটা দিন ওর চোখে পানি থাকত।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘এরপর এলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমার মা’সহ পরিবারের সবার সঙ্গে ছোট্ট রাসেলও বন্দি ছিল। সেই বন্দিদশা থেকে এক সময় কামাল-জামাল চলে গেল যুদ্ধে। এ অবস্থায় সব সময় রাসেলের চোখে পানি থাকতো। কিন্তু সে দুঃখ আড়াল করতো। তার সেই নীরব কান্না কখনো প্রকাশ করতো না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবসময় বাবাকে হারানোর ভয়ে থাকতো রাসেল। আব্বা বাসায় থাকলে খেলাধুলার ফাঁকে একটু পর পর সে আব্বাকে দেখে যেত। বাবার আশেপাশে সে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াতো। এভাবেই সে বড় হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর বাবাকে সে কাছে পেয়েছিল। তারপর তো সবই শেষ।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘রাসেলের স্বপ্ন ছিল সে সেনাবাহিনীর অফিসার হবে। গ্রামে গেলে বাচ্চাদের সে প্যারেড করাতো। রাসেলের ইচ্ছায় শিশুদের কাপড় দিতে হতো। ওর মনটা ছিল খুব উদার।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, ‘শিশুদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতেই শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ গঠন করা হয়।’

এ সময় কবি সুকান্তের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

 

সূত্র: বাসস

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button