গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে চায় সরকার। এ অর্থ ফেরত আনাটা বেশ জটিল। পাচারকারী যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, তার সমপরিমাণ অর্থ দেশীয় উৎস থেকে বাজেয়াপ্ত করা যায় কি-না তা ভেবে দেখছে সরকার।
এদিকে বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সর্বোচ্চ পাচার হয় এমন ১২টি দেশের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদনের এটাসহ বেশকিছু সুপারিশ করা হয়।
সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের নিমিত্তে তথ্য আদান-প্রদানসহ একটি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সম্প্রতি বিএফআইইউ প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনআরবি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিনিধিও ছিলেন।
ওই কমিটি বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার সম্পর্কিত মামলা, বিদ্যমান আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তথ্য বিনিময়ের বিভিন্ন জটিলতা, বিভিন্ন দেশের আইনকানুন পর্যালোচনা করে কার্যকর অর্থ উদ্ধার কার্যক্রমের কৌশল নির্ধারণে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে।
এ প্রতিবেদন অনুমোদন ও সুপারিশমালার বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির ১৮তম সভা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের প্রতিনিধি বৈঠকে যুক্ত হয়ে প্রস্তাব করেন অর্থপাচার করেছে, এমন তথ্য প্রমাণিত হলে ওই ব্যক্তির দেশে বিদ্যমান সমপরিমাণ সম্পত্তি বা অর্থ বাজেয়াপ্তের মাধ্যমে অর্থ ফেরানো যায়। এ বিষয়টি বাস্তবায়ন করা যায় কি-না তাও বিবেচনা করা হবে বলে বৈঠকে আলোচনা হয়।
তিনি আরও বলেন, বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসহ ১২টি দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। এই অর্থ ফেরত আনতে এসব দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সমোঝতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক চুক্তি করার কথাও বলা হয়।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আরও বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো– বিভিন্ন দেশে কী পরিমাণ অর্থ ইতোমধ্যে পাচার হয়েছে তা নির্ধারণে একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে এবং আগামীতে পাচার রোধে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা। চলতি বছর এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) বার্ষিক সম্মেলন বাংলাদেশে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেটা হয়নি। তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেটা মালয়েশিয়ায় হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সম্মেলনে অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সহযোগিতা কামনা করা।
যেসব দেশে এ বৈধভাবে টাকা যায় সে দেশেরও নৈতিক দায়িত্ব এর উৎস জানতে চাওয়া। তাহলে টাকা পাচারটা কমে যায়। কিন্তু ওইসব দেশের সাথে চুক্তি না থাকলে তারা নিজে থেকে এ কাজগুলো করে না। কারণ তাদের অর্থনীতিতে তো টাকা ঢুকছে। এ বিষয়ে এপিজির কাছে সহযোগিতা চাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এসব ক্ষেত্রে নতুন এপিজির সহযোগিতা কামনা করা হলে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মানি লন্ডারিং ইস্যু জানতে চাইবে। দেশের অভ্যন্তরীণ মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুপারিশও করা হয়। এটর্নি জেনারেল অব বাংলাদেশ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, দুদক, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ এ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সমন্বয় বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং পাচার রোধে দূতাবাসগুলোতে গোয়েন্দা কার্যক্রম রাখতে হবে। আর্থিক কর এবং দুদকের প্রতিনিধিদের ওইসব জায়গায় কিছু সময়ের জন্য পদায়ন করা যেতে পারে। অ্যাসেট রিকভারি এবং ট্যাক্স রিকভারি দুই পদ্ধতি অবলম্বন করা। অ্যাসেট রিকভারি যদি কঠিন হয় তাহলে ট্যাক্স রিকভারি করতে হবে।
অর্থপাচার রোধে আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবার ওপর ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং করা, শিপমেন্টের ওপর আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং করা, আমদানি-রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং করা এবং রফতানি পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা দেয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন যথাযথভাবে দেশের ব্যাংকগুলোকে মেনে চলতে বাধ্য করারও সুপারিশ করা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির নিয়মিত বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের পাশাপাশি আগামীতে কীভাবে অর্থপাচার রোধ করা যায় সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে অর্থ পাচার বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের দুটি বাজেটের সমান। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে অর্থপাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
গত ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থপাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা।
এতে বলা হয়েছে, আমদানি-রফতানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েসের মাধ্যমেই প্রধানত অর্থপাচার করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।
এছাড়া সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বছর যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে সেখানে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা এর আগের বছর থেকে দেড়শ কোটি টাকা কমেছে।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থপাচার এবং সেই অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় পাচারের পরিমাণ বেড়েই চলছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, এটার প্রবাহ বন্ধ করা এবং অর্থ ফিরিয়ে আনা– দুটোর জন্যই তেমন কোনো ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
সূত্র: জাগো নিউজ