মামলা করতে পারেনি একরামুলের পরিবার, কথা বলাও নিষেধ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ‘‘এমপি বদি চাইলে আমার স্বামীকে (একরামুল হক) বাঁচাতে পারতেন। আমরা ফোন করার পর তিনি চেষ্টা করেননি। আমি আমৃত্যু আমার স্বামী হত্যার বিচার চাইতেই থাকব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আমরা স্বামী হত্যার বিচার চাই।’’
বিশ্ব গুম দিবসে শুক্রবার টেকনাফের নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম এসব কথা বলেন। গত বছরের ২৬ মে মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে একরামকে হত্যা করা হয়।
একরামের দুই মেয়ে তাদের পড়ার ঘরের দেয়ালকে প্রতিবাদের দেয়ালে পরিণত করেছে। দেয়ালে তারা লিখে রেখেছে বাবা হারনো ব্যথার কথা, কষ্টের কথা। তারা লিখেছে, আমাদের আব্বু কি কোনো বিচার পাবো না? তুমি কি আর জীবনেও আসবে না? নির্দোষ মানুষকে কেন মারে? আব্বু তুমি চলে এসো।”
এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও একরামের পরিবার কোনো মামলা করতে পারেনি। তারা মামলা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। একরামের স্ত্রী বলেন, ‘‘মামলাতো দূরের কথা আমাদের এ নিয়ে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে। মামলা করলে আমরা টিকতে পারবনা।’’
একরাম হত্যার পর একটি মোবাইল অডিও প্রকাশ হয়। আর তাতে স্পষ্ট হয় একরামকে কারা কিভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু সেই অডিও ধরে কোনো তদন্ত হয়নি। একরামের স্ত্রী বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে ডিজিএফআই এর লোকজন নিয়ে র্যাবের হাতে তুলে দেয়। কারা তাকে হত্যা করেছেন তা আমি জানতে চাই। তারা আমার মোবাইল ফোনটিও বার বার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। এই মোবাইলেই আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পর কথা হয়েছে। মোবাইল ফোনটি না দেয়ায় আমি এখনো চাপে আছি।’’
ঘটনার পর ওবায়দুল কাদের সাহেব ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করেছিলেন। তারা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একরামের স্ত্রীকে দেখা করিয়ে দেবেন। কিন্তু এরপর আর কেউ যোগাযোগ করেননি বলে জানান একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম। তিনি কান্নজড়িত কন্ঠে বলেন,‘‘আমার মেয়েরা এখনো কাঁদে। সবার বাবা আছে আমার সন্তানদের বাবা নেই। ঈদ আসে, কোরবানি আছে কিন্তু বাবা ছাড়াই আমার সন্তানদের কাছে এইসব উৎসবের দিন। আমি কি আমার নিরপরাধ স্বামী হত্যার বিচার পাবনা।’’
তিনি বলেন,‘ আমার স্বামীকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করা হয়েছে। সে তো মাদক ব্যবসায়ী ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন একথা। একরামকে নিয়ে যাওয়ার পর আমার দেবর এমপি বদি ভাইকে ফোন করেছিলেন। তিনি শুধু বলেছেন ও ওখানে কেন গেছে? বদিতো জানতে কারা মাদক ব্যবসায়ী ৷ সে চাইলে আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারত। কিন্তু তিনি তা করেননি।’’
এই ঘটনায় র্যাবের পক্ষ থেকে তখন টেকনাফ থানায় একটি মামলা করা হয়।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস জানান,‘‘বন্দুক যুদ্ধে একরাম নিহত হওয়ার মামলাটির তদন্ত চলছে। এখানো কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যায়নি। আর একরামের পরিবারের পক্ষ থেকেও কেউ মামলা করেনি।” এ বিষয়ে র্যাবের কারুর বক্তব্য জানা যায়নি।
বাংলাদেশে গুম বা বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় বিচার পাওয়ার নজীর নেই বললেই চলে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসেবে ২০১৪ থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ৩৪৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৬০ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ফিরে এসেছেন ৩৫ জন। বাকি ২০৫ জন ফিরে আসেনি।
আসক এক বিবৃতিতে জানায়, এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবী করেছেন যে, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে তাদের তুলে নেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গুম হওয়ার অনেকদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়রে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।
২০১৩ এভাবেই ঢাকার সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজনকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তার খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। তার ভাই জাহিদ খান জানান,‘‘আমাদের মামলাও নেয়নি পুলিশ৷ অনেক যোগাযোগের পর জিডি নিয়েছে। এক বছর পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাসায় আসেন। তারা বলেন আমার ভাই ফিরে আসবে। আমরা যেন সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা না বলি। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি।” মাহবুবের স্ত্রী ও দুই সন্তান আজও তার জন্য অপেক্ষায় আছেন।
আসকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন,‘‘নিখোঁজ হওয়ার পর যারা ফিরে আসেন তারা কথা বলতে চান না। আর যারা কথা বলেন তার খুব ভীত থাকেন। অসংলগ্ন কথা বলেন। আমাদের মনে হয়েছে হয়েছে নিখোঁজ থাকার সময় তারা এমন পরিস্থিতির মধ্যে থাকেন যা তাদের মৃত্যু ভয়ের মধ্যে ফেলে দেয়।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে