বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক ৮৮৪৮ বাংলাদেশী

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ হাজার ৮৪৮ জন বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে বা ডিটেনশন সেন্টারে আটক আছেন বলে সংসদে তথ্য দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সংসদে দেয়া তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বন্দি আছেন ভারতে। এছাড়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান ও কুয়েতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের এক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় সংসদে বিদেশে বাংলাদেশী বন্দিদের এ তথ্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্ব টেবিলে উত্থাপিত হয়।
সংসদে উত্থাপিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন ভারতে। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন কারাগারে বন্দি বাংলাদেশীর সংখ্যা ২ হাজার ৪৯।
জানা গেছে, ভারতের কারাগারে বন্দি বাংলাদেশীর একটি অংশ এখান থেকে পাচার হওয়া নারী ও শিশু। মানব পাচারকারীরা বাংলাদেশী নারী ও শিশুদের পাচারে যে রুটগুলো ব্যবহার করে, ভারত সেগুলোর একটি। সেখানে ভারতের সীমান্তরক্ষীসহ অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ায় বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রাখা হয় তাদের। এছাড়া সাগরে ভেসে যাওয়া জেলেও প্রায়ই বন্দি হন ভারতীয় কোস্টগার্ডের কাছে। তাদেরও ফেরত আসার আগ পর্যন্ত বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়। আর যেসব বাংলাদেশী অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন, তাদের আটক করে ভারতের আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়। শাস্তি ভোগ শেষে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাদের।
ভারতের পর সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন সৌদি আরবে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশটির কারাগারে বন্দি বাংলাদেশীর সংখ্যা ১ হাজার ২৮৯।
সৌদিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, সৌদি আরবে অবস্থান করা বাংলাদেশী শ্রমিকরা আকামায় (কাজের অনুমতিপত্র) উল্লিখিত পেশা ও যে কোম্পানি বা মালিকের অধীনে কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে, সেখানে কাজ না করে অন্য স্থানে বা অন্য কোনো পেশায় কাজ করায় সৌদি আরব সরকার তাদের আটক করছে। মূলত সৌদি আরবে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১২ পেশায় প্রবাসীদের কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় এসব পেশায় কর্মরত বৈধ প্রবাসী শ্রমিকদেরও ইকামা (বসবাসের অনুমতিপত্র) নবায়ন করা হচ্ছে না। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা বৈধ প্রবাসীরাও অবৈধ হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থায় অনেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার আটক হয়ে দেশটিতে বন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছেন।
জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছর সৌদি আরব সরকার ১২টি পেশায় প্রবাসীদের কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় দীর্ঘ বছর ধরে যেসব বাংলাদেশী সৌদি আরবে ছিলেন, তাদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে গেছে। তাদের অনেককেই দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করছে।
বিদেশে তৃতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বন্দি রয়েছেন ১ হাজার ১৫৬ জন বাংলাদেশী।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর বিদেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন বাহরাইনে, ৬৯৩ জন। দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৪ আগস্ট এক বাংলাদেশী শ্রমিক কর্তৃক বাহরাইনের ইমামকে হত্যার পর থেকেই সেখানে থাকা অবৈধ বাংলাদেশীদের আটক করতে শুরু করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বছর আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৬৬ জন বাংলাদেশী শ্রমিককে দেশে পাঠিয়েছে বাহরাইন সরকার।
বাহরাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর শেখ তাহিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বাহরাইনে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন। তবে বিভিন্ন কারণে এর মধ্যে ৭০ হাজার শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়েছেন। অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশটির পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগ।
বাংলাদেশী শ্রমিকদের বৈদেশিক শ্রমবাজারের অন্যতম মালয়েশিয়া। তবে অবৈধ উপায়ে দেশটিতে গিয়ে আটক হচ্ছেন অনেকেই। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণেও আটক হচ্ছেন কেউ কেউ। চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিখোঁজের ঘটনাও ঘটছে। সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশটিতে বন্দি ছিল ৫৭২ জন বাংলাদেশী।
জানা গেছে, সর্বশেষ গত বুধবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ৪৪ অবৈধ বাংলাদেশী আটক হন। এর আগে ৭ জুলাই মালয়েশিয়ার সেপাং নদীর ১০০ মিটার ভেতরে জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে ৩৩ বাংলাদেশীকে আটক করে দেশটির পুলিশ।
বর্তমানে ওমানে আট লাখের মতো বাংলাদেশী শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিকই দেশটিতে পাড়ি দিয়েছেন ফ্রি ভিসায়। ফ্রি ভিসায় যাওয়া শ্রমিকদের স্থায়ী কাজ না থাকায় নিজেদের কাজের সন্ধান করতে হচ্ছে নিজেদেরই। অনেকেই আবার দালালের মাধ্যমে দেশটিতে গেছেন অবৈধভাবে। আবার কিছু বাংলাদেশী আছেন, যারা বৈধভাবে গেলেও চুক্তি অনুযায়ী কম বেতন পাওয়া এবং মাস শেষে বেতন না পাওয়ার কারণে মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে অবৈধ হয়ে কাজ করছেন। মাঝেমধ্যেই পুলিশের হাতে আটক হচ্ছেন তারা।
জাতীয় সংসদে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার পর বিদেশী সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাবে ওমানে বন্দি বাংলাদেশীর সংখ্যা ৪৪২।
বিদেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী বন্দি থাকা শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে এর পরই কাতার। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাবে দেশটির কারাগারে বন্দি রয়েছেন ৩৫১ বাংলাদেশী। এছাড়া কুয়েতে বন্দি বাংলাদেশীর সংখ্যা ৩১৬, তুরস্কে ৩০০ ও ইরাকে ২৭৫ জন। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৯, ইরাকে ২৭৫ ও গ্রিসে ১০৬ জন বাংলাদেশী বন্দি রয়েছেন। আর ইরানে বন্দি ২৫০ জনের মধ্যে ২৩৩ জনকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে লিখিত বক্তব্যে বলেন, কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশের কারাগারে আটক বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম দায়িত্ব। এটা রুটিনমাফিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দূতাবাসের সাহায্যে করে আসছে। যখনই কোনো বাংলাদেশীর প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়ে, দূতাবাস সংশ্লিষ্ট দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সে দেশের আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রবাসীদের জন্য ভ্রমণ ডকুমেন্ট (পাসপোর্ট/ট্রাভেল পাস) তৈরি করে দেয়। অনেক সময় সাজার মেয়াদ কমিয়ে দেয়া, সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নেয়া অথবা আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা পরিচালনা করে আটককৃতদের মুক্তির ব্যবস্থা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে করে আসছে। অতি সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ভানুয়াতুতে আটকে পড়া অনেক বাংলাদেশী দূতাবাসের সার্বিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন বা বাংলাদেশে ফিরে আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।