গাজীপুর

ইটভাটার সারি খোদ গাজীপুর নগরেই

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশন এলাকায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। ওই আইন না মেনে গাজীপুর মহানগরীর কড্ডা, ইসলামপুর, বাইমাইল ও কোনাবাড়ী এলাকায় চলছে অবৈধ দেড় শতাধিক ইটভাটা। বেশির ভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও আবাসিক এলাকার আশপাশে। ভাটাগুলোর বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। ছড়িয়ে পড়েছে রোগব্যাধি।

অভিযোগ রয়েছে, অসত্য তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট মামলার আদেশ নিয়ে মালিকরা বছরের পর বছর ধরে ইটভাটাগুলো চালাচ্ছেন। এ কারণে বাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে ওই সব এলাকা।

গত মঙ্গলবার গাজীপুর মহানগরীর কড্ডা, বাইমাইল ও বাঘিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশে যত দূর চোখ যায় শুধু ভাটা আর ভাটা। ইটভাটার চিমনিগুলো থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া। কোনোটার ধোঁয়া কালো, কোনোটার সাদা। ধোঁয়া ভেদ করে সূর্যের আলো পৌঁছতে না পারায় আকাশ হয়ে আছে মেঘলা। মাটিতে জমে আছে ধূলিকণা ও ছাইয়ের মোটা স্তর। ভাটাগুলোতে ইট, মাটি, বালু ও কয়লা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত অসংখ্য ট্রাক চলাচলের কারণে উড়ছে ধুলা ও ছাই। সেই ধুলা-ছাই ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও কলকারখানায়।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও বাঘিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে ইটভাটা গড়ে উঠেছে সাতটি। সবচেয়ে কাছের মেসার্স বাঘিয়া অলি ব্রিকসের পরিচালক জহিরুল ইসলাম জানান, শুধু বাঘিয়া ও আশপাশের এলাকায় ইটভাটা রয়েছে ৫৬টি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলে ২০১৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর এলাকার সব ইটভাটা বন্ধের নোটিশ দেয়। বাধ্য হয়ে তাঁরা উচ্চ আদালতে আশ্রয় নিয়ে রিট আবেদন করেন। আদালত ভাটা বন্ধের আদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। এর পর থেকে প্রতিবছরই ইট পোড়ানো মৌসুম শুরুর আগে উচ্চ আদালতে রিট করে আদেশ পেয়ে ভাটা চালাচ্ছেন।

তিনি আরো জানান, ১০ বিঘা জমি ভাড়া নিয়ে তাঁরা কয়েকজন মিলে ইটভাটাটি করেছেন। এতে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় দুই কোটি টাকা। কোটি টাকার ওপর ব্যাংকঋণ রয়েছে। ভাটায় কাজ করছে চার শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। ইটভাটা বন্ধ করে দিলে ব্যাংকঋণ পরিশোধ সম্ভব হবে না। অন্য কারখানার মতো ইটভাটার চুলা বা চিমনি স্থানান্তর করা যায় না। সব কিছু আবার নতুন করে করতে হয়। প্রয়োজনীয় জায়গা ও টাকার অভাবে তাঁরা ভাটা স্থানান্তর করতে পারছেন না।

বাঘিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তালহা, জুবায়ের ও আসাদুল্লাহ জানায়, স্কুলের ভেতরে-বাইরে এবং আশপাশে সব সময় ইটভাটর ধুলা ও ছাই উড়ে। এক জামা দ্বিতীয় দিন পরে স্কুলে আসা যায় না। এক দিনেই জামাকাপড় লাল হয়ে যায়। ধুলার জন্য বসে টিফিনও খাওয়া যায় না। অনবরত ধুলাবালির কারণে তারা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বাইমাইল এলাকার বাসিন্দা হাজি জহিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলে নগরীর আওতাধীন সব ইটভাটা সরিয়ে নেওয়ার নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে স্থগিত করা হয় ইটাভাটা পরিচালনার লাইসেন্স ও পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন। বন্ধ রাখা হয় ট্রেড লাইসেন্স। ব্যাংকঋণ ও ভাটা স্থানান্তরের ক্ষতি উল্লেখ করে মালিকরা ইটভাটা সরিয়ে নিতে দুই বছর সময় দাবি করেন। উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মানবিক দিক বিচার করে মালিকদের দাবি মেনে নেওয়া হলেও তাঁরা একটি ইটভাটাও সরিয়ে নেননি। বরং দুই বছর পর তাঁরা আদেশ স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করলে ইটাভাটা সরানোর আদেশ আটকে যায়। আদালত প্রথম বছর ছয় মাসের জন্য আদেশ স্থগিত করেন। এর পর থেকে প্রতিবছরই ইট পোড়ানোর মৌসুম শুরুর আগে ‘ব্যাংক লোন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান’ ইত্যাদি প্রায় একই তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করে আদেশ এনে ইটভাটা চালাচ্ছেন মালিকরা। তাঁদের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। ইটভাটার মালিকরা মামলা করলে তাঁরা মোকাবেলা না করে হাত গুটিয়ে নীরব থাকেন।

নগরীর কড্ডা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ইটভাটা মালিকদের প্রায় সবাই প্রভাবশালী। কেউ সাবেক চেয়ারম্যান, কেউ বর্তমান কাউন্সিলর, রাজনৈতিক দলের বড় নেতা বা বড় ব্যবসায়ী। ভাটা সরানোতে তাঁদের আগ্রহ নেই। আগে লাইসেন্স নবায়ন, ছাড়পত্র ও ট্রেড লাইসেন্স পেতে নানা শর্ত ও নিয়ম মানতে হতো। এখন মামলার আদেশে ইটাভাটা চালানোর কারণে তাঁরা কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছেন না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রাহাতুল ইসলাম জানান, মহানগরীতে কোনো অবস্থাতেই ইটভাটা থাকতে পারে না। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর ইটভাটা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন কঠোর অবস্থানে থাকবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুরের উপপরিচালক আবদুস সালাম সরকার জানান, তাঁদের তথ্য অনুযায়ী মহানগরীতে ৮৫টি ইটভাটা রয়েছে। সবগুলো ভাটাই অবৈধ। আগে উচ্চ আদালতে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজস্ব আইনজীবী না থাকায় মালিকরা একতরফা সুবিধা পেতেন। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ায় শুনানি শেষে আদালত অনেক আবেদন খারিজ করে দিচ্ছেন। শীঘ্রই সব মামলা মোকাবেলা করে গাজীপুর মহানগরী থেকে ইটভাটা উচ্ছেদ করা হবে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, আদালতের নির্দেশনা নেই, গত দুই সপ্তাহে এমন ৯টি ইটভাটা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাড়ে চার লাখ টাকা জরিমানাসহ ইট তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। গাজীপুর নগরীকে একটি আদর্শ ও পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button